কেন মেহগনি-রেইনট্রি-ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগাবেন না?

সম্পা আক্তার

এপ্রিল ৩০, ২০২৪, ০৫:৪৭ পিএম

কেন মেহগনি-রেইনট্রি-ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগাবেন না?

ছবি: বন অধিদপ্তর

দেশের বর্তমান দাবদাহ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফল। এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য তাই গাছ লাগানোর বিষয়টি অপরিহার্য মনে করছেন অনেকেই। তবে দ্রুত বর্ধনশীল ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় মেহগনি, রেইনট্রি বা ইউক্যালিপ্টাসের মতো বিদেশি গাছ এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এসব গাছের ভালো দিকগুলো জানা থাকলেও এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। আবার অনেকেই দ্রুত লাভের আশায় জেনেশুনেও এই গাছ লাগাচ্ছি। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

রাস্তার দুই ধারে, বাড়িঘরের আশপাশে, বনের টিলায় মেহগনি, রেইনট্রি বা ইউক্যালিপ্টাস গাছই আজকাল বেশি চোখে পড়ে। যা পরিবেশের জন্য ভালোর চেয়ে ক্ষতির কারণ বেশি। তবে এই গাছের কাঠ ছাড়া অন্যকোন ব্যবহার নেই। এই ফল কোনো পশু-পাখি ভক্ষণ করে না ও কোনো পাখি গাছটিতে বাসা বাঁধে না। ব্যাপক বিস্তারে অন্য গাছগুলোর সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। যে কারণে জীববৈচিত্র্যের জন্য বহিরাগত প্রজাতির গাছ খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া মেহগনি গাছের পাতার ক্ষতিকারক রস মাটিকে অনূর্বর করে তোলে, কোনো কীটপতঙ্গ বাঁচতে পারে না।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “বিভিন্ন প্রজাতির ভিনদেশি গাছের বনায়ন কৃষি ও প্রাণ বৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে।”

তিনি আরও বলেন, “বিদেশি গাছ আমাদেরকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে। মেহেগনি, রেইনট্রি বা ইউক্যলিপ্টাসের মতো বিদেশি গাছ না লাগিয়ে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানোর সচেতনতা বাড়ানো দরকার।”

কারণ আমাদের দেশীয় বনজ, ফলজ ও ঔষধি গাছ পরিবেশের জন্য অনেক বেশি উপকারী। রোদের তাপ ঠেকাতে মাতৃবৃক্ষ রোপণে নজর দিতে হবে। কারণ গ্রীষ্মের রোদে অনেক গাছের মৃত্যু হয়। তবে এ সময় দেশি গাছগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ফলে পরিবেশ ঠিক রাখতে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানোর প্রতি আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

তিনি আরও বলেন, “মেহগনি বা রেইনট্রি গাছের মত বিভিন্ন বিদেশি গাছ মাটির পুষ্টি গুণাগুণ নষ্ট করে ফেলে। এছাড়া এসব গাছের পাতার ক্ষতিকারক রস মাটিকে অনূর্বর করে তোলে। ফলে মেহগনি-রেইনট্রি গাছ যে স্থানে লাগানো হয় তার আশেপাশে পর্যন্ত কোথাও কোনো কীটপতঙ্গ সহজে বাঁচতে পারে না।”

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “ এই গাছের ফল কোনো পশু পাখি ভক্ষণ করে না ও কোনো পাখি গাছটিতে বাসা বাঁধে না। এসব গাছ আমাদের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। ফলে এই গাছ জীববৈচিত্র্যকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”

এছাড়া গাছের পরাগায়ণ সাধারণত পাখিদের বিচরণ বা কীটপতঙ্গের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে বিদেশি গাছগুলো কীটপতঙ্গ বা পাক পাখির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সেক্ষেত্রে পরাগায়ণ ব্যাহত হয়। যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।

কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “এই গাছ পানি দূষণও করে থাকে। মেহগনি-রেইনট্রি গাছের পাতা পানিতে পড়লে তা পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। ফলে এসব গাছের পাতা পুকুরের পানিতে পরলে বিষাক্রিয়ায় মাছ মরে যাবার মত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।”

তিনি আরও বলেন, “প্রচণ্ড গরমের কারণে এই সময় অনেকেই গাছ লাগানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে এটি গাছ লাগানোর সঠিক সময় নয়, আমাদেরকে বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গাছ লাগানোর আগে কোনো গাছ কোন জায়গায় লাগানো উচিত সেটিও খেয়াল রাখা দরকার।”

আমাদের দেশের আরেকটি জনপ্রিয় বিদেশি গাছের নাম ইউক্যালিপ্টাস। ইউক্যালিপ্টাসে খুব দ্রুত বেড়ে উঠার কারণে ও রোগবালাই কম দেখা যাওয়ায় এর জনপ্রিয়তা মোটামুটি ভালোই বলা চলে। তবে এর ক্ষতিকর দিকই বেশি। আবার অনেকেই দ্রুত লাভের আশায় জেনেশুনেও এই গাছ রোপণ করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মাদ ফিরোজ জামান বলেন, “কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ অতিরিক্ত হওয়ায় এই গাছ তাপমাত্রা বাড়ায়। এই গাছগুলো পাখি বাসা বাধার উপযোগী নয়। এর আশেপাশে অন্য প্রজাতির গাছ লাগালে তা অপুষ্টির কারণে জন্মাতে পারে না।”

শুধু তাই নয়, ইউক্যালিপ্টাস গাছ রাতদিন পানি শোষণ করে বাতাসে ছাড়ে। ফলে এই গাছের আশপাশের প্রায় ১০ ফুট এলাকার ও ভূগর্ভের প্রায় ৫০ ফুট নিচের পানি শোষণ করে। পরে তা আকাশে উঠিয়ে দেয়। এর ফলে এই গাছ লাগালে আশেপাশের মাটিতে জলের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই ইউক্যালিপ্টাস গাছ শুষ্ক বা মৌসুমী জলবায়ু যুক্ত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

তিনি আরও বলেন, “রেইনট্রি বা মেহগনি গাছ অনেক বেশি লম্বা হয়ে থাকে। ফলে এই গাছের আশেপাশে অন্য গাছ সহজে বেড়ে উঠতে পারে না। এছাড়া এই গাছ থেকে ঝরা পাতা নদী বা খালে পড়লে ফসল ও মাছের জন্য ক্ষতিকর করে। রেইনট্রি গাছের কাঠও নিম্নমানের। এই গাছই হয়ে উঠতে পারে পরিবেশের জন্য বিপদজনক কারন সব গাছেই যে অক্সিজেন দেয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নেয় ব্যপারটা কিন্তু এমন নয়।”

এছাড়া বিদেশি গাছ না লাগিয়ে দেশি গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি। কারণ মেহগনি, রেনট্রি বা ইউক্যালিপ্টাসের মতো বিদেশি গাছগুলো পরিবেশের ইকোসিস্টেমকে নষ্ট করে দেয়। ফলে এসব গাছে উপকার থেকে অপকারই বেশি।

গাছপালা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল রাখে; এদিকে বাংলাদেশে ২৫ শতাংশের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ খুবই নগণ্য। ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। আকস্মিক এই দাবদাহ অনেকটা নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। এখন আমরা যে পরিবেশ সংকটে ভুগছি এর জন্য আমরাই দায়ী। এর থেকে রেহাই পেতে প্রচুর দেশীয় গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন পরিবেশবিদরা।

Link copied!