কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্র ব্যবহার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত, বিজ্ঞান কী বলে?

ইউএনবি

জানুয়ারি ২৩, ২০২৪, ০৯:৫৪ এএম

কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্র ব্যবহার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত, বিজ্ঞান কী বলে?

সংগৃহীত ছবি

শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা নয়, রান্নার কাজে কাঁসা, পিতল ও তামার পাত্র ব্যবহার সুস্থ জীবন ধারণের সঙ্গেও সম্পর্কিত।

ধাতব বস্তুগুলোর প্রাচীন মান ও নান্দনিকতার বাইরেও সেগুলোর বিশেষ গুণ হচ্ছে সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত তাপ পরিবাহিতা ও দীর্ঘস্থায়ীত্ব। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এমন টেকসই গড়নের নিচে লুকিয়ে থাকা কিছু বৈশিষ্ট্য, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবেই আঞ্জাম দিতে পারে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস।

এই বৈশিষ্ট্যগুলোর বৈজ্ঞানিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়েই আজকের নিবন্ধ। চলুন, কাঁসা, পিতল ও তামার পাত্র ব্যবহার কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত তা জেনে নেয়া যাক।

কাঁসার পাত্র ব্যবহারের উপকারিতা

হজম ও বিপাকে কার্যকারিতা

কাঁসার ক্ষারীয় বৈশিষ্ট্য খাদ্যের অম্লতাকে প্রশমিত করে। ফলে পানি বা খাদ্যে থাকা পানির পিএইচের (পটেনশিয়াল অফ হাইড্রোজেন) স্তর উন্নত হয়। এই পিএইচ মূলত পানির দ্রবণে অম্ল বা ক্ষারের উপস্থিতি নির্ণয়ের মাপকাঠি। এভাবে রান্না করা খাবারটি বিশুদ্ধ হয়ে হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে।

চর্বি কমানো

কাঁসা এমন একটি সংকর ধাতু যাতে যথেষ্ট পরিমাণে তামা থাকে, যেটি চর্বি ভেঙে ওজন কমানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এটি রান্নায় অতিরিক্ত চর্বি ও তেলের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে খাবারের সর্বত্রে সমানভাবে তাপ বিতরণ করে।

ব্যথানাশক ক্ষমতা

কাঁসার ভেতরে থাকা তামা শরীরের সবখানে রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। ফলে কালশিটে পড়া পেশি, ব্যথা হওয়া জয়েন্টগুলো এবং এমনকি আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রেও ভালো বোধ হয়।

শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

সারারাত ধরে কাঁসার পাত্রে পানি সংরক্ষণ করা হলে পানিতে একাধিক পুষ্টি যোগ হয়। এই পানি পানের মাধ্যমে শরীরে শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক পুষ্টিগুলোর চাহিদা পূরণ হয়।

কাঁসার পাত্র ব্যবহারে সতর্কতা

পুরনো কাঁসার পাত্রে সীসা বা আর্সেনিক থাকতে পারে, যা রান্নার সময় খাবারে প্রবেশ করতে পারে।

অক্সিডেশন এড়াতে কাঁসা পাত্রগুলো ব্যবহারের পরে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া উচিৎ। এর জন্য কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে। অতঃপর তাতে অল্প ডিটারজেন্ট দিয়ে আলতোভাবে পাত্রটি পরিষ্কার করতে হবে।

পিতলের পাত্র ব্যবহারের উপকারিতা

দ্রুত ক্ষত নিরাময় ও কোষের বৃদ্ধি

পিতল এমন একটি সংকর ধাতু যেখানে যথেষ্ট পরিমাণে দস্তার উপস্থিতি বিদ্যমান। দস্তা প্রদাহ কমাতে, দ্রুত ক্ষত নিরাময়, কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি নিরবচ্ছিন্ন বিপাকের ক্ষেত্রেও সহায়ক। তাই শরীরে দস্তার ঘাটতি থাকলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পাশাপাশি পিতলের তৈজসপত্রে রান্না করা বা খাবার খাওয়া শুরু করা যেতে পারে।

সংক্রমণ প্রতিরোধী

ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিরুদ্ধে পিতল বেশ কার্যকর। অন্যান্য পাত্রের তুলনায় পিতলের পাত্রগুলো খাবারকে দীর্ঘ সময়ের জন্য উষ্ণ রাখে। ফলে রান্না করা খাদ্য যে কোনো সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে।

হজমের জন্য ভালো

অম্লত্ব হ্রাস করার মাধ্যমে গ্যাসট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো বিভিন্ন ধরনের হজমের সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা করে। ফলে পাকস্থলি পরিষ্কার হয়ে পুষ্টি শোষণ ক্ষমতা বাড়ে এবং অন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে।

পিতলের পাত্র ব্যবহারে সতর্কতা

নিয়মিত খাবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই পাত্রটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। নতুবা উল্টো সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তাপ ধরে রাখা এবং বিশুদ্ধ রাখতে রান্না করা খাবার ঠিকভাবে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।

হালকা তাপে রান্না বা ফুটানো যে কোনো রান্নার জন্যই পিতল একটি আদর্শ ধাতু। তবে অতিরিক্ত ভাজার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা তেল গরম হওয়ার জন্য অধিক তাপের প্রয়োজন হয়, যা টিনের আস্তরণকে প্রভাবিত করতে পারে। পরবর্তীতে এতে সংরক্ষণকৃত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বাটার মিল্ক, লাচ্ছি, জ্যাম, সস, আচার, দুধ, পনির ও দই জাতীয় খাবার এবং জ্যুস তামা বা পিতলের পাত্রে সংরক্ষণ করা উচিৎ নয়।

তামার পাত্র ব্যবহারের উপকারিতা

ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী

খাবার পানি সরবরাহের পাইপ এবং গৃহস্থালির কলগুলো সাধারণত তামা দিয়ে তৈরি করা হয়। কারণ তামায় রয়েছে জীবাণু প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য। তামার পাত্রে জমা পানি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ই. কোলাই নির্মূল করতে পারে। এছাড়া সালমোনেলা, টাইফাস, শিগেলা এসপিপি, কলেরা, এন্টেরোভাইরাস এবং হেপাটাইটিস এ-এর মতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতেও এটি বেশ কার্যকর।

থাইরয়েডের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে

থাইরয়েড গ্রন্থির সঠিক কার্যকারিতা নির্ভর করে শরীরে থাকা তামার পরিমাণের ওপর। তামার ঘাটতি থাকলে থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে। তামার পাত্রে পানি খাওয়া বা সংরক্ষণ করা এই ঝুঁকি দূর করতে পারে।

আর্থ্রাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াই করে

কাঁসার মতো তামারও রয়েছে প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য, যা আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য জয়েন্টের ব্যথা উপশমের জন্য সহায়ক। বিশেষত এর প্লেকটিং বৈশিষ্ট্যটি শরীরের জয়েন্টের ব্যথা এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিস সৃষ্ট প্রদাহ দ্রুত সারাতে সক্ষম।

অ্যানিমিয়া প্রতিরোধকারী

রক্তাল্পতা প্রতিরোধে তামার ওষুধি ক্ষমতা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। তামার পাত্রে সংরক্ষিত পানি রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি হার্টে রক্ত প্রবাহ বাড়ানোর জন্য রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করার পাশাপাশি নালীর প্রাচীরে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে।

ক্ষত নিরাময়কারী

তামার পেপটাইড সেরা নিরাময় এজেন্টদের মধ্যে একটি। ক্ষত এবং ত্বকের ক্ষতির চিকিৎসার জন্য এমন অনেক চিকিৎসা পণ্য আছে যেগুলোর মূল উপাদান এই তামা পেপটাইড। এটি সাধারণত কোলাজ উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কোলাজ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে। আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যত বেশি সক্রিয় হবে, শরীরের যে কোনো ক্ষত তত দ্রুত সেরে উঠবে।

ক্যান্সার কোষ ধ্বংস

এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোর আরও বড় একটি গুণ হচ্ছে- এগুলো যাবতীয় ফ্রি র‍্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই ফ্রি র‍্যাডিক্যালগুলো মূলত মানবদেহে ক্যান্সারের প্রধান কারণ।

ত্বক ও চোখের যত্ন

মেলানিন তৈরিতে তামার গুরুত্ব অপরিসীম। এই মেলানিন মানবদেহের ত্বক এবং চোখের উজ্জ্বল রঙ ধরে রাখতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, এটি সূর্যের ক্ষতিকারক অতি-বেগুনি (ইউভি) রশ্মি থেকেও রক্ষা করে ত্বক ও চোখকে।

গর্ভবতী মায়ের জন্য সহায়ক

আরবিসি (রেড ব্লাড সেল বা লোহিত রক্ত কণিকা) উৎপাদনের জন্য যথোপযুক্ত কাঁচামালের যোগান দেয় তামা। এটি আরবিসির উৎপাদন বাড়িয়ে টিস্যুর মেরামত এবং শর্করা হজম করতে সাহায্য করে। এই সুবিধাগুলোর প্রতিটিই প্রয়োজন গর্ভবতী মায়েদের জন্য। তামা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় গর্ভের সন্তানের হৃৎপিণ্ড, রক্তনালী, কঙ্কাল এবং স্নায়ুতন্ত্র গঠনে।

তামার পাত্র ব্যবহারে সতর্কতা

তামার অ্যালার্জি থাকা খুব একটা দেখা যায় না। এরপরেও তামাতে যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের এই ধাতু থেকে দূরে থাকতে হবে। এই ধরনের তৈজসপত্র ব্যবহার বা তা থেকে পানি পান করলে ফুসকুড়ি বা চুলকানি হতে পারে।

সাধারণত এই ধাতুর পাত্র থেকে বারবার পানি পান করলে তামার বিষাক্ততা ছড়াতে পারে। ফলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঝুঁকি থাকে বমি বমি ভাব, বমি, পেট ব্যথা এবং ডায়রিয়ার। শরীরে প্রয়োজনীয় পরিমাণে তামার চাহিদা পূরনের জন্য দিনে দুইবার (সকাল এবং সন্ধ্যা) তামার বোতলে জমা পানি পান করাই যথেষ্ট।

পিতল ও কাঁসার মতো তামার ক্ষেত্রেও ব্যবহারের পর নিয়মিত পাত্র পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি। থালা সাবান বা লেবু এবং লবণ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী উপায়েই তৈজসপত্র পরিষ্কার করা যেতে পারে।

সংগ্রহ বা ক্রয়ের সময় কাঁসা, পিতল ও তামা প্রতিটির ক্ষেত্রেই ধাতুটি খাঁটি কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। পানি বোতলে ভরে সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজে রাখা যাবে না।

শেষাংশ

বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ এই তত্ত্ব-উপাত্তগুলো উপযুক্তভাবে ন্যায্যাতা দান করে কাঁসা, পিতল ও তামার পাত্রের ব্যবহারকে। বর্তমান সময়ের রান্নার কাজে ব্যবহার্য সামগ্রীর যে কোনোটির তুলনায় এগুলো অধিক স্বাস্থ্যকর। নিদেনপক্ষে এখন যেখানে জীবাণুবাহী রোগগুলোর দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, সেখানে আধুনিক তৈজসপত্রগুলোর ওপর এই জীবাণু বিরোধী ধাতুগুলোর প্রাধান্য থাকবে।  তবে ক্রয়ের পূর্বে ধাতুগুলোর বিশুদ্ধতা যাচাই করে নেওয়া অত্যাবশ্যক। অতঃপর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা হলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকিগুলো এড়ানো সম্ভব হবে।

Link copied!