দেশের নাম ও জাতীয় সংগীত ঘোষণার দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্চ ৩, ২০২১, ০৪:১৫ পিএম

দেশের নাম ও জাতীয় সংগীত ঘোষণার দিন

আজ ৩ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই দিন  পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পার্লামেন্টারি পার্টিগুলোর নেতাদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

বিকেলে ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল ছাত্রসভা। এ সভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর সামনে পাঠ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার। এটি লিখেছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন দপ্তর সম্পাদক এম এ রশীদ।

Shahjahan
সভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর সামনে পাঠ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার। ছবি: সংগৃহীত

ইশতেহারে বলা হয়, ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গ মাইল ভৌগোলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।

ইশতেহারে আরও বলা হয়, দেশ গঠনের পর তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে-১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে;২. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসণের জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক শ্রমিক রাজনীতি কায়েম করতে হবে;৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।

ইশতেহারে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকটি কর্মপন্থা উল্লেখ করা হয়। তার মধ্যে-১. বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা;২. সকল শ্রেণির জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদের ঐক্যবদ্ধ করা;৩. শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করা;৪. হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙালি সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার এবং সিম্প্রীতি বজায় রাখা;৫. স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা এবং লুটতরাজসহ সকর প্রকার সমাজবিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করা উল্লেখযোগ্য।

ইশতেহারে ঘোষিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা

১.

বর্তমান সরকারকে বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকার গণ্য করে এর সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা করতে হবে।

২.

তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পিবাহী পশ্চিমা অবাঙালি মিলিটারিকে বিদেশি ও হামলাকারী শত্রু সৈন্য হিহেবে গণ্য এবং এ হামলাকারী শত্রুসৈন্যকে খতম করতে হবে।

৩.

বর্তমান বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে সকল প্রকাল ট্যাক্স-খাজনা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

৪.

স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলারত যে কোনো শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্য সকর প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।

৫.

বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

৬.

কবিগুরু রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে জাতয়ি সংগীত হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

৭.

শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানি দ্রব্য বর্জন এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

৮.

উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।

৯.

স্বাধীনতা সংগ্রাামরত বীর সেনানিদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। একই  সঙ্গে ওই সভায় বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পাশাপাশি ৩ মার্চের ঐহিতাসিক সভায় স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে বেশ কয়েকটি স্লোগানের কথা উল্লেখ করা হয়। স্লোগানগুলো হলো- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, দীর্ঘজীবী হউক’; ‘স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ  স্বাধীন কর’; ‘স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব’; ‘গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুবিজবাহিনী গঠন কর’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’; ‘মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও’।

ইশতেহার ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড করতালির মধ্যে প্রস্তাব  গৃহীত হলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা।

৩ মার্চের ওই জনসভাতেই ঘোষণা আসে ৭ মার্চে রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবুর রহমান ভাষণ দিবেন। ৭ মার্চের জনসভা যাতে না করতে পারে তার জন্য ওইদিন পাকিস্তান সরকার জারি করে সান্ধ্য আইন। তবে তা উপেক্ষা করেই অব্যাহত থাকে জনতার  বিক্ষোভ ও মিছিল।

Link copied!