দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে। হাপিত্যেশ করছেন নাগরিকরা। সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেছে রাজধানীর তাপমাত্রা। এমনই পরিস্থিতিতে একটি শিরোনামে সবার চোখ পড়ে- ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। যার লক্ষ্য প্রচণ্ড গরমে ঢাকা উত্তরকে নিরাপদ রাখার বিষয়ে নেতৃত্ব দেওয়া।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠেছে সমালোচনার ঢেউ। ঢাকা উত্তর সিটিতে ‘চিফ হিট অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বুশরা আফরিন মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে হওয়ায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
এই পদ থাকার যৌক্তিকতা, নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মাপকাঠি নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। আরও উঠেছে, বিশ্বের আর কোথায় কোথায় এই পদ আছে? আর এত লোক থাকতে মেয়রের মেয়েই কেন এই পদে নিযুক্ত হলেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওঠা এসব প্রশ্নেরই বেশ কিছু উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। অনেকে চালিয়েছেন অনুসন্ধানও।
যেভাবে এলো চিফ হিট অফিসারের ধারণা
তাপপ্রবাহের তীব্রতায় ধুঁকছে দেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই বিপদ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের (আর্শট-রক) ও এক্সট্রিম হিট রেজিলিয়েন্স অ্যালায়েন্স (ইএইচআরএ) বিশ্বের প্রথম ‘চিফ হিট অফিসার’ পদ তৈরি করে একটি প্রকল্প হাতে নেয়।
এদেশের মানুষের কাছে চিফ হিট অফিসার পদটি পরিচিত নয়। আর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই কৌতুহল প্রকাশ করেছেন। চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হতে কি যোগ্যতার দরকার হয়, কেমন অভিজ্ঞতার ভেতর যেতে হয়- এসব নিয়ে জানতে উদ্গ্রীব হয়েছেন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
চিফ হিট অফিসারদের কাজ হলো- চরম ভাবাপন্ন এলাকার তাপমাত্রার জন্য তাদের সরকারের নেওয়া সব ধরনের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন। বিদ্যমান তাপ সুরক্ষা প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত ও নাগরিকদের চরম তাপের ঝুঁকি ও প্রভাব নিরসনে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া এবং তার বাস্তবায়নও তাদের দায়িত্ব।
শহরেই চিফ হিট অফিসারের প্রয়োজন কেন?
জলবায়ু পরিবর্তন ‘তাপ দ্বীপের প্রভাব’ বাড়িয়ে তুলছে, যেখানে শহরগুলো প্রায়শই কাছাকাছি গ্রামীণ এলাকার তুলনায় কয়েক ডিগ্রি বেশি উত্তপ্ত থাকে।
বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল শহরগুলওর প্রায় ২০ শতাংশ, ২০৫০ সালের মধ্যে ৪ ডিগ্রির বেশি ও প্রায় ২৫ শতাংশ, ২১০০ সালের মধ্যে ৭ ডিগ্রির বেশি উষ্ণ হবে। তাপ-সম্পর্কিত ক্ষতির জন্য ২১০০ সালের মধ্যে জিডিপির ২ দশমিক ৩ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলো ২১০০ সালের মধ্যে জিডিপির ১০ দশমিক ৯ শতাংশ হারাতে পারে।
তাই বর্তমানে গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় শহরেই চিফ হিট অফিসারের প্রয়োজনীয়তা বেশি।
চিফ হিট অফিসার নিয়োগের কারণ
একটি শহরের মেয়র বা সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে উষ্ণতা কমাতে যখন কোনো কর্মসূচি হাতে নেন, তখন তারা এই পদ তৈরি করতে পারেন।
আর্শট-রক একজন ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ দেয়। এছাড়াও তারা ‘চিফ হিট অফিসার’ পদের কাজের বিবরণ তৈরি করে। ‘চিফ হিট অফিসারের’ লক্ষ্য ও কার্যক্রমকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য ইএইচআরএ সদস্যদের সবসময় সম্পৃক্ত রাখে।
চিফ হিট অফিসার নিয়োগ করেছে যারা
না, ডিএনসিসি নয়, আর্শট-রক ফাউন্ডেশন তাপ কমাতে ঢাকা উত্তরে নানা কর্মসূচি পরিচালনার জন্য বুশরা আফরিনকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ দিয়েছে। এর মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটিতে এশিয়ার প্রথম শহর হিসেবে একজন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হলো।
বুশরার বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা আর্শট-রক ফাউন্ডেশনই দেবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘ডিএনসিসির সাংগঠনিক কাঠামোতে চিফ হিট অফিসার নামে কোনো পদ নেই। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ নামে কোনো শাখা বা বিভাগও নেই। মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে বুশরা আফরিনকে উত্তর সিটির কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।’
বুশরা আফরিনকে এই পদে নিযুক্ত করেছে আর্শট-রক ফাউন্ডেশন নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের এশিয়া অঞ্চলের জন্য কাজ করবেন তিনি।
গত বছরের ৩ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক অনুষ্ঠানে এই চুক্তি ও নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।
বুশরার যোগ্যতা
বুশরা আফরিন কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে পড়াশোনা করেছেন। বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শক্তি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার।
সেখানে তিনি বাংলাদেশের পোশাক খাতের পোশাক শ্রমিকদের সুরক্ষা ও আরও টেকসই পণ্য সরবরাহ করতে কাজ করেছেন।
এছাড়া আর্শক-রক এ বহু বছর ধরে নগরে তীব্র তাপপ্রবাহ নিয়ে তিনি কাজ করছেন। সৃষ্ট সমস্যাগুলোর বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সমাধান খুঁজে বের করে তার বাস্তবায়নে জোর দেয় তারা।
বিশ্বের কোথায় কোথায় চিফ হিট অফিসার
এশিয়ার আর কোনো দেশে ‘চিফ হিট অফিসার’ নেই। বুশরাই প্রথম কোনো এশীয় ব্যক্তি হিসেবে এই পদে নিয়োগ পেলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি ও ফ্লোরিডা, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন, গ্রিসের অ্যাথেন্স, চিলির সান্তিয়াগো, মেক্সিকোর মনটেরেই ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এই পদে নিযুক্তরা কাজ করে যাচ্ছেন।
চিফ হিট অফিসাররা সান্টিয়াগোতে কুলিং পেভমেন্ট, কুল রুফ, ফ্রিটাউনে ভবনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন, কিছু শহর বনায়নসহ নানা উপায় প্রয়োগ করে আসছেন।
বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের সমাধানোপযোগী পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের পরিকল্পনা আছে বুশরার। তীব্র দাবদাহ থেকে ঢাকা উত্তরের বাসিন্দাদের তিনি কতখানি স্বস্তি দেবেন, সময়ই সেটা বলে দেবে।