জুলাই ১৫, ২০২৫, ০৫:৫২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
তাদের বুকে পদক ঝোলানো, পেছনে ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতীক। সব মিলিয়ে তারা যেন মুসলিম বিশ্বের রক্ষক, ধর্মের প্রহরী, জাতির অভিভাবক। বিশ্বের অন্যতম বড় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তারা। পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডারও রয়েছে, আর শাসন করছে এমন একটি রাষ্ট্র; যা একসময় নিপীড়িতদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
কিন্তু গাজা যখন রূপ নেয় এক গণকবরে, যখন ফিলিস্তিনি মায়েরা রক্তমাখা কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে রাখেন নিজের সন্তানের মৃতদেহ; তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থাকে নিস্পৃহ। শুধু ‘গভীর উদ্বেগ’ নামের পুরোনো বুলি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। কিন্তু কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর জটিল নয়। তারা নীতিহীনতায় মোড়া। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনী, যাদের হাতে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র এবং যারা ২৪ কোটির বেশি মানুষকে শাসন করে, তারা কেন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সামান্য কার্যকর অবস্থানও নেয় না? একটি শব্দে এর উত্তর ‘জায়োনিজম’ (ইহুদি রাজনৈতিক মতবাদ বা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন)। এটি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ নয়; বরং সামরিক ও রাজনৈতিক অভিজাতদের মননে গজিয়ে ওঠা বিদেশপন্থী, নীতিহীন জায়োনিজম। এরা মুসলিম উম্মাহর রক্ষক নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত আজ্ঞাবহ পাহারাদার। এরা ভণ্ডামির ফুলঝুরি ছড়াতে ওস্তাদ।
মিডল ইস্ট মনিটরের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
এতে বলা হয়, ‘কৌশলগত সংযম’ কিংবা ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা’—এসব উঁচু বুলি প্রকৃতপক্ষে একধরনের নীরব সহযোগিতার আবরণ। পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত। বহু দশক ধরে এই সেনা কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে শুধু যুদ্ধকৌশল নয়, শেখানো হয় সাম্রাজ্যের মূল্যবোধে আনুগত্য বজায় রাখার কৌশল—ওয়াশিংটনের প্রতি আনুগত্য, তেল আবিবের প্রতি নম্রতা ও পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোনো সত্যিকারের প্রতিরোধকে ঘৃণা করা। দেশে ফিরে তারা নিয়ে আসেন চকচকে সনদ, ফুলে ওঠা অহংকার আর একধরনের নিষ্ঠুর অন্ধত্ব; যা গাজার আর্তনাদ শুনতে অক্ষম।
আর পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ? আল্লাহ তাদের অসীম ধৈর্য দান করুন। তাদের বিশ্বাস করানো হয়, সেনাপ্রধান নিয়োগ একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি হয়ে থাকে হয়তো জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে কিংবা সৃষ্টিকর্তার ইশারায়! কিন্তু বাস্তবতা আরও ঔপনিবেশিক—সেনাপ্রধানের নিয়োগ হয় ইসলামাবাদে নয়, ওয়াশিংটনে। পাকিস্তানি জেনারেলরা নিজেদের সার্বভৌমত্বের রক্ষক বলে দাবি করেন। তারাই প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যের ফ্র্যাঞ্চাইজি ম্যানেজার। তাদের প্রকৃত মালিকেরা ইংরেজি বলেন বিদেশি টানে আর ফিলিস্তিনকে দেখেন এক অপ্রয়োজনীয় আপদ হিসেবে।
পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে ধরা যাক। সরকারঘেঁষা গণমাধ্যম তাকে একপ্রকার ‘মসিহা’রূপে উপস্থাপন করে। বলা হয়ে থাকে, তিনি পবিত্র কোরআনের হাফেজ, সেনাবাহিনীর নৈতিক দিকনির্দেশক। কিন্তু ভাবা যায়? যিনি পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেছেন, তিনি গাজার বিপর্যয়ের বিষয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন না। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পররাষ্ট্রনীতির পদক্ষেপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া!
আর হ্যাঁ, সেই ট্রাম্প—যিনি জেরুজালেমকে একতরফা ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, শান্তির নামে বিভাজন ও বর্ণবাদের চুক্তি করেছেন এবং গোলান মালভূমি নেতানিয়াহুকে বিলিয়ে দিয়েছেন, যেন জুয়ার টোকেন। এমন একজন যুদ্ধপিপাসুকে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করা পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল সম্মান জানালেন। ট্রাম্প তা গর্বের সঙ্গে নিলেন। এ ছিল এক বিদ্বেষের যুগল বন্দনা; যেখানে দুই নেতা যেন গণহত্যার প্রতি মৌন সমর্থনে একে অপরের হাত মেলালেন।
তবে মুনির শুধুই একটি উপসর্গ; ব্যাধিটি গভীরে। পাকিস্তানি জেনারেলদের ‘জায়োনিজম’ ইসরায়েলি রকমের নয়—তা আরও ছলনাময়, কাপুরুষোচিত ও মুনাফালোভী। এটি নীরবতার জায়োনিজম। এটি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকীকরণের জায়োনিজম; যেখানে ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য নিপীড়িত গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আইএমএফের ঋণ প্যাকেজ আর পেন্টাগনের প্রশংসা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা বোমায় ফিলিস্তিনিরা মরলেও পাকিস্তানি জেনারেলরা ক্ষুব্ধ হন না এবং ‘কূটনৈতিক ভারসাম্য’ বজায় রাখার জন্য নিজেদের আলোচনার বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করতে থাকেন।
আর যখন গাজার কথা বলেন, সেটাও হয় আমলাতান্ত্রিক ভাষায়। না থাকে ক্ষোভ, না থাকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, না থাকে হৃদয়ের ক্ষরণ। শুধু শুষ্ক এক বিবৃতি, ‘পাকিস্তান নিন্দা জানায়…’। এরপরই ওয়াশিংটনের পথে পাঠানো হয় আরও অর্থসহায়তার আবেদন। নিজেদের বীরত্বে গর্বিত সেনাবাহিনী যখন গণহত্যার সামনে এতটাই নিরুপায় হয়, তখন তা একেবারেই কাপুরুষতার পরিচায়ক।
বিপরীত আচরণ স্পষ্ট হয় কাশ্মীর ইস্যুতে। নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বুক ফুলে ওঠে বলিউডের এক্সট্রাদের মতো। ৪৮ ঘণ্টার সীমান্ত উত্তেজনাতেও বিমান ওড়া শুরু করে, মন্ত্রীরা পতাকা নাড়েন, আইএসপিআর দেশপ্রেমে ভরা গান তৈরি করে যুদ্ধের জরুরি তাগিদে। আমাদের আবার বলা হয়, তারা জাতির গর্ব, মুসলিমদের সম্মানের রক্ষক। কিন্তু ইসরায়েলি ট্যাংক যখন গাজায় প্রবেশ করে, হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দেয়, শরণার্থীশিবিরে আগুন লাগায়—তখন? তখন নিস্তব্ধতা। কার্যকর সাড়ার নামগন্ধটুকু নেই।
এই বৈপরীত্য ভয়াবহ। গাজায় শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচে মারা যায়, আর পাকিস্তানের তথাকথিত ‘মুসলিম বিশ্বের রক্ষকেরা’ তাদের পদক পালিশ করেন, ট্রাম্পের জন্য অভিনন্দনপত্র লেখেন। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামেন, ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়ান, নিজের সামান্য সঞ্চয় দান করেন। কিন্তু শাসকেরা—সেনা অভিজাত শ্রেণি, রয়ে যান তাদের সাম্রাজ্যের ঘোরে।
পাকিস্তানে বুলি কম নেই। ব্যানারে ‘কাশ্মীর বানেগা পাকিস্তান’, ‘লাব্বাইক ইয়া আকসা’—এসব স্লোগান থাকলেও ভেতরে–ভেতরে এ এক প্রহসন। ফিলিস্তিন–সংকট ফাঁস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গড়ে তোলা আত্মপ্রচারমূলক পুরাণ—এ এক কল্পকাহিনি মাত্র। এতে উন্মোচিত হয় এমন এক শাসকগোষ্ঠী, যারা পশ্চিমা অনুমোদন ও জায়োনিস্ট কাঠামোর দাসত্ব মেনে নিয়েই নিপীড়ন চালিয়ে যেতে চায়।
অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে—ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে পাকিস্তানের কী এমন খরচ? একটা মেডিকেল ইউনিট পাঠানো? মিসর সীমান্ত দিয়ে ত্রাণবাহী কূটনৈতিক বহর? ইসরায়েলি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলোর পণ্য বর্জনের ঘোষণা? এসবের একটাও করতে হয় না তাদের। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, উদ্দেশ্য বর্তমান ব্যবস্থাকে অক্ষত রাখা। জেনারেলরা জানেন, গাজার পাশে দাঁড়ানো মানেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। এমন অবস্থান নেওয়া তাদের জন্য অকল্পনীয়।
আরও ভয়ংকর এক আশঙ্কা রয়েছে। সেটি হলো, পাকিস্তানি সামরিক অভিজাত শ্রেণি হয়তো ইসরায়েলের ভেতরেই নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। যে সেনাবাহিনী নিজ ঘরে ভিন্নমত দমন করে, নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে, সাংবাদিক গুম করে—তারা হয়তো ইসরায়েলের দমন-পদ্ধতিকে ঈর্ষা করে। হয়তো এ কারণেই তাদের অনেক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় ইসরায়েলঘেঁষা বিশ্ববিদ্যালয়ে—ন্যায় রক্ষার পাঠ নয়; বরং নিপীড়নকে ‘পরিচালনার’ কৌশল শিখতে।
এভাবেই চলছে এক প্রহসনের রাজনীতি। গাজা পুড়ে ছারখার হয় আর পাকিস্তানি জেনারেলরা পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে সেলফি তোলেন। এক সেনাপ্রধান (মুনির) নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেন এক যুদ্ধাপরাধীকে (ট্রাম্প)। তাদের (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) সামরিক বাজেট ফুলেফেঁপে ওঠে, কিন্তু নৈতিক সাহস শুকিয়ে যায়।
কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ এর চেয়ে ভালো কিছু ডিজার্ভ করেন। তারা কাপুরুষ নন। তারা বিশ্বাসঘাতকও নন। করাচি থেকে খাইবার—মানুষ ফিলিস্তিনের পাশে আছেন, শুধু কথায় নয়, হৃদয়ের ব্যথা দিয়ে। তারা বোমা দেখে শোক জানান, জানেন—নীরবতা মানেই সহায়তা। অথচ তারা শাসিত হচ্ছেন এমন এক শ্রেণিকে দিয়ে, যারা ফিলিস্তিনকে দেখছে পিআর সমস্যা (ভাবমূর্তির ঝামেলা) আর পেন্টাগনকে অভিভাবক হিসেবে।
পাকিস্তানের প্রয়োজন প্যারেড নয়, উড়ন্ত যুদ্ধবিমান নয়; প্রয়োজন নৈতিক স্পষ্টতা। প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা ‘গণহত্যা’ আর ‘ভূরাজনীতি’র পার্থক্য বুঝতে পারে। প্রয়োজন এমন জেনারেল, যারা পবিত্র কোরআনের আয়াতকে শুধু উদ্ধৃত করা নয়, বাস্তবেও তা প্রয়োগ করেন। প্রয়োজন এমন জেনারেল, যাঁরা লোকদেখানো নয়; বরং ন্যায়ের লক্ষ্যে সাহসকে হাতিয়ার করেন।
সোজাসাপটা বললে, যে দেশের সেনাবাহিনী গাজার চেয়ে ওয়াশিংটনকে বেশি ভয় পায়, সেই দেশ এখনো সার্বভৌম নয়। তারা নিজেদের আত্মা ইজারা দিয়েছে।
তাই, সেই পদক থাকুক ধুলামাখা। সেই খুতবা থাকুক থেমে। জেনারেলরা আর তাদের চাটুকার দল থাকুক পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে ভোজসভায়। ইতিহাস তাদের মনে রাখবে না সম্মানের সঙ্গে। গাজার শিশুদের যখন গণকবরে শোয়ানো হবে, তখন পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শালকে মনে রাখা হবে সেই মানুষ হিসেবে; যিনি এক গণহত্যাকারীকে শান্তির পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন।
যত দিন না পাকিস্তানের সামরিক অভিজাতরা ঔপনিবেশিক আনুগত্য ঝেড়ে ফেলবেন, নিপীড়িকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন, তত দিন সেনাবাহিনীর এসব উঁচু পদ—চিফ অব আর্মি স্টাফ, ফিল্ড মার্শাল, স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড—সবই এক কাপুরুষতার পদবিতে রূপ নেবে।
আর জনগণ? তাদের উচিত হাততালি বন্ধ করা; যা সৌভাগ্যবশত অনেকেই ইতিমধ্যে বন্ধ করেছেন। ভণ্ডামিতে ডুবে থাকা জেনারেলদের ‘দেবতা’ বানানো বন্ধ করা। পোশাককে মর্যাদার সমার্থক ভাবা বন্ধ করা। কারণ, যখন পরবর্তী গাজাগুলো পুড়বে, তখনো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যারাক থেকে যে নীরবতা ভেসে আসবে, সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত পরিচয়।
আর সেই নীরবতাই হবে তাদের ঐতিহ্য।
(প্রথম আলোর অনুবাদ থেকে নেওয়া)