ট্রাম্পের শুল্কের লক্ষ্য এশীয় দেশগুলো, জয়ী কে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ১৪, ২০২৫, ০১:২৭ পিএম

ট্রাম্পের শুল্কের লক্ষ্য এশীয় দেশগুলো, জয়ী কে

ছবি: সংগৃহীত

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পাল্টা শুল্কের হুমকিকে ‘গভীরভাবে দুঃখজনক’ আখ্যা দিয়েছেন। ট্রাম্প জাপানি পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে ক্ষুব্ধ টোকিও। দেশটি বহুদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সংঘাত এড়াতে অনেক চেষ্টা করছে।

জাপানের গাড়িশিল্প এমনিতেই বিপর্যস্ত। সে জন্য তারা চাইছে, এ শিল্পের জন্য কিছু ছাড় দেওয়া হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকা সত্ত্বেও নিজেদের চালের বাজার উন্মুক্ত করতে রাজি নয় তারা।

ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পর্যন্ত কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ট্রাম্প যখন বন্ধু ও প্রতিপক্ষ সবাইকে লক্ষ্য করে একযোগে শুল্ক আরোপ শুরু করেন, তখন থেকে জাপানি প্রতিনিধিদল অন্তত সাতবার ওয়াশিংটন সফর করেছে। তবে এসব আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি বলেই ধারণা। একসময় ট্রাম্প জাপানকে দুর্ধর্ষ’ বললেও এখন বলছেন, জাপান সহযোগিতা করছে না।

গত সপ্তাহে জাপানসহ ২৩টি দেশকে নতুন শুল্কের চিঠি পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ১৪টি দেশই এশিয়ার। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কাবেশির ভাগই রপ্তানিনির্ভর উৎপাদন খাতনির্ভর অর্থনীতি।

শুক্রবার ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, কানাডার ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। একই সঙ্গে বেশির ভাগ বাণিজ্য অংশীদারের ওপর ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন তিনি। এমনকি এও বলেছেন, আরও শুল্ক আরোপে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নিয়েও তিনি চিন্তিত নন।

ট্রাম্প এনবিসি নিউজকে বলেন, ‘বাকি সব দেশকে এখন থেকে ১৫ বা ২০ শতাংশযেটা হয় হোক না কেন, শুল্ক দিতে হবে। সেই হিসাব আমরা এখন ঠিক করে নিচ্ছি।’ 

আগামী ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন ট্রাম্প। এর মধ্যে সবাইকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। কিন্তু জাপানের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্র এত চেষ্টার পরও শুল্কের মুখে পড়ায় অন্য দেশগুলোর আশাবাদ অনেকটাই কমে গেছে।

যেসব দেশ আগে শুল্ক হুমকির মুখে পড়েছিল, তারা এ সময় বাড়ানোয় কিছুটা সুবিধা পেয়েছে। এখন তাদের হাতে সমঝোতার জন্য আরও ১৫ দিনের বেশি সময় আছে।

ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকের গবেষণা প্রধান সান টেক কিন বলেন, আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে, আগস্টের সময়সীমার আগে আবার আলোচনা শুরুর জন্য চাপ তৈরি হয়েছে।

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলো এখন সমাধানের খুঁজতে বিশেষভাবে আগ্রহী। তারা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনার মধ্যে পড়ে গেছে। কারণ, ট্রান্সশিপমেন্ট বা জাহাজীকরণেও শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, অর্থাৎ চীনের পণ্য অন্য দেশ দিয়ে ঘুরিয়ে রপ্তানি করা হলে (ট্রানশিপমেন্ট) বাড়তি শুল্ক দিতে হবে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অ্যালেক্স ক্যাপরি জানান, এ চুক্তিগুলো এত জটিল যে ভবিষ্যতে সময়সীমা আরও বাড়তে পারে। ট্রাম্প যেসব দাবি করেছেন, তার ভাষা পরিষ্কার না হওয়ায় দেশগুলোকে প্রস্তুতি নিতে সময় লাগবে।

উদাহরণ হিসেবে অ্যালেক্স বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তিতে এই ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য শুল্কের আওতায় আনা হলেও, সেটা কেবল চূড়ান্ত পণ্যের জন্য প্রযোজ্য, নাকি সব ধরনের উপাদানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তা পরিষ্কার নয়। তার মতে, ‘এ পুরো বিষয়ের সঙ্গে অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী ও তৃতীয় পক্ষ জড়িত। ফলে বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে।’  

ট্রাম্পের শুল্ক কৌশল থেকে এটা স্পষ্ট, শুল্ক আর অস্থায়ী বিষয় নয়। বৈশ্বিক বাণিজ্য সে কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনের অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এ ঝুঁকিতে আছে। এতে কেবল রপ্তানিকারক নয়, আমদানিকারক ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারাও ক্ষতির মুখে পড়বেন।

বিশেষ করে এশিয়ার অনেক দেশের অর্থনৈতিক উত্থান ইলেকট্রনিকস থেকে পোশাকশিল্প ও নির্মাণভিত্তিক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এ শুল্ক বড় ধাক্কা দেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

অ্যালেক্স ক্যাপরি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক কিছু জড়িত আছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য। তাই এখানে ‘কে জিতল, কে হারল’ বিশ্লেষণ ঠিক নয়। তবে কিছু দেশ তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান আর্থিক শক্তি ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের জোরে কিছুটা সময় নিতে পারবে।

ভারত এখনো চিঠি পায়নি। দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি এই হলোএমন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের মূল বিরোধ হলো কৃষি খাত উন্মুক্ত করা ও আমদানির নিয়মাবলি নিয়ে মতানৈক্য।

বিশ্লেষকেরা বলেন, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে এশীয় অন্যান্য দেশের মতোই বিবেচনা করছে। বিষয়টি সম্পর্ককে নতুন দিকে ঠেলে দিতে পারে।

জাপান যদিও চালসংকটে ভুগছে ও তাদের বাজারে দাম বাড়ছে। দেশীয় কৃষকদের সুরক্ষা দিতে প্রধানমন্ত্রী ইশিবা যুক্তরাষ্ট্রের চাল কিনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মার্কিন দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।

বিশ্লেষকেরা বলেন, জাপান ভালোভাবে প্রস্তুত। ট্রাম্প এপ্রিলে শুল্ক ঘোষণা দেওয়ার পরদিনই টোকিও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় শত শত পরামর্শ কেন্দ্র খুলেছে। জাপান বিশ্বাসযোগ্য চুক্তি চায়, অর্থাৎ ট্রাম্প যেন পরদিনই মত পাল্টাতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছে তারা।

জুলাই মাসে জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন। তাই আগস্টের মধ্যে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

জয়ী কে, যুক্তরাষ্ট্র না চীন

এশিয়ার ময়দানে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এ শুল্ক কৌশলে চীন সুযোগ পাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, ট্রাম্প সময় বাড়িয়ে নিজের অবস্থান দুর্বল করে ফেলেছেন। এ চুক্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নিজের কার্ড দেখিয়ে ফেলেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, তাদের অবস্থান অতটা শক্ত নয়। চুক্তি হলেও দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যকাঠামো ভেঙে যেতে পারে।

চিঠিগুলো কূটনৈতিক মাধ্যমে না পাঠিয়ে অনলাইনে পোস্ট করা ভুল কৌশল ছিল বলে মনে করেন ক্যাপরি। তার মতে, ‘এটা রাজনৈতিক নাটক’। এর মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

এ বিভ্রান্তিকে নিজেদের ‘স্থিতিশীল’ ভাবমূর্তি তুলে ধরার সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার চট করে বদলানো যায় না এবং চীনের সঙ্গেও এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর টানাপোড়েন আছে।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মূল চুক্তি করার সময় আছে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত। কে বেশি বন্ধু পাবে এ বাণিজ্যযুদ্ধে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উভয় পক্ষই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে, কিন্তু এ বিচ্ছেদ এক দিনে হবে না, অন্তত কয়েক দশক লাগবে।

Link copied!