২৫ অনুর্ধ গর্ভবতী-স্তনদায়ী মায়েদের টিকা নিবন্ধন হবে কীভাবে?

তুহিন কান্তি দাস

আগস্ট ২১, ২০২১, ১০:৪৫ পিএম

২৫ অনুর্ধ গর্ভবতী-স্তনদায়ী মায়েদের টিকা নিবন্ধন হবে কীভাবে?

সরকারি অনুমোদন থাকলেও ২৫ বছরের কম বয়েসী অন্তঃসত্ত্বা এবং বুকের দুধপান করানো মায়েদের জন্যে জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে নেই টিকা নিবন্ধনের ব্যবস্থা। জাতীয় সুরক্ষা প্রোগ্রামের 'নাগরিক নিবন্ধন (২৫ বছর ও তদুর্ধ)' সূচী নির্বাচন করে কেবল ২৫ বছর এবং তদুর্ধরা টিকার নিবন্ধন করতে পারছেন।চিকিৎসক, সাস্থ্যকর্মীসহ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতরা জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপের নিবন্ধন করতে পারলেও গর্ভবতী এবং মাতৃদুগ্ধ দানকারী  মায়েরা পাচ্ছে না সে সুযোগ।  তাই প্রশ্ন উঠছে ১৮-২৪ বছরের অন্তঃসত্ত্বা এবং মাতৃদুগ্ধ দানকারী মায়েরা টিকা গ্রহন করতে পারবে না?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যেহেতু সরকার গর্ভবতী মায়েদের টিকার অনুমোদন দিয়েছে এখন উচিৎ হবে তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা। সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল গর্ভবতী মায়েদের টিকাদানে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্য রিপোর্টকে জানান, গর্ভবতী মায়েদের টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা উচিৎ। এইখানে দুইটা জীবনের বিষয় আছে। উন্নতদেশে এই বিষয় নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা হয়েছে, গবেষণা হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে গর্ভবতী মায়েদের টিকা দেওয়ার ফলে বাচ্চাদের প্যারাডোজিনিক কোন ইমপেক্ট নেই। মায়ের টিকা নেওয়ার ফলে তার বাচ্চার ক্ষতির নজির পাওয়া যায়নি। সুতরাং আমি মনে করি গর্ভবতী মায়েদের অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি লেক্টেটিং মাদার বা মায়ের দুধ পান করানো মায়েদেরও এইখানে যুক্ত করা উচিৎ। একই সাথে ব্যপক প্রচার-প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। 

আগস্ট মাসের শুরুতে গর্ভকালীন এবং মাতৃদুগ্ধ পান করানো মায়েদের টিকা দেয়ার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। গর্ভবতী মায়েদের টিকাদানে ঝুঁকির তুলনায় সুফল অধিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানায় স্বস্থ্য অধিদপ্তরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। কিন্তু জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনায় ব্যবহৃত সুরক্ষা প্রোগ্রামের(অ্যাপে) মাধ্যমে নাগরিক নিবন্ধনে গর্ভবতী কিংবা প্রসূতি মায়েদের জন্যে কোন বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় নাগরিক নিবন্ধনে হচ্ছে তাদের টিকার রেজিষ্ট্রেশন।

আবার নাগরিক নিবন্ধন উন্মুক্ত রাখা হয়েছে ২৫ বছর এবং তার চেয়ে বেশি বয়েসীদের জন্যে। এখন পর্যন্ত ২৫ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশি নাগরিকরা জাতীয় নিবন্ধন প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এর মানে ১৮-২৪ বছরের গর্ভবতী এবং প্রসূতি মায়েরাও টিকা নিবন্ধন করতে পারবে না। টিকা নিবন্ধন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার কারণে টিকার সুফল বঞ্চিত হবে তারা। এই অবস্থায় ২৫ বছরের কম বয়েসী গর্ভবতী এবং প্রসূতি মায়েদের টিকা নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হলে জতীয় সুরক্ষা অ্যাপে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করতে হবে অথবা বিকল্প কোন উপায় খুঁজতে হবে।

অন্তঃসত্ত্বা এবং বুকের দুধপান করানো মায়েদের টিকাদানে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা হবে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দ্য রিপোর্টকে বলেন,না অগ্রাধিকার প্রক্রিয়ায় কখনই যাবে না। এইটাতো প্রায়োরিটি ক্রাইটেরিয়াতে পড়ে না। বরং প্রেগনান্ট উইমেনদের ক্ষেত্রে তথ্যের লিমিটেশানস আছে, এখন পর্যন্ত সাফিশিয়েন্ট তথ্য নাই যে এটা প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে সেইফ কি, সেইফ না। যারা নিতে চায়, তারা জেনে নেবে। সে বিষয়টায় আমরা কনসেন্ট্রেট করেছি এইখানে। যারা জেনেও নিতে চাইবে যে প্রেগন্যান্ট ভ্যাক্সিন নিরাপদ বিষয়ে খুব বেশি তথ্য নেই আমাদের কাছে, তাদের আমরা এলাউ করছি। আমরা এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার তালিকায় নিবো না।

ঝুঁকির তুলনায় অধিক সুফল বিবেচনায় গর্ভবতী টিকাদানের অনুমোদন দিয়েছে সরকার এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, আমরা সেটা বলিনি। সুফল বেশি কি কম সেটা আমরা বলতে পারি না। যে কারণে এই বিষয়টা(গর্ভবতী টিকাদানের সিদ্ধান্ত) নিয়ে আমরা সময় নিয়েছি। এই বিষয়ে খুব বেশি গবেষণালব্ধ তথ্য নেই। ডাব্লিউএইচ এটা বলেছে যে যাদের কোভিড হলে রিস্ক বেশি, কোভিড সংক্রমণে ঝুঁকি বেশি তাদের রিস্ক-বেনিফিট এনালাইসিস করে টিকা দিতে। এই বিষয়টা একটু ক্রিটিক্যাল,এইখানে স্ট্রেট-ফরওয়ার্ড কিছু বলা যাচ্ছে না অন্যান্য টিকার মতো তিনি যুক্ত করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক ডাটাসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দল স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অব এক্সপার্ট-সেইজ(SAGE) টিকাদানের কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা এনেছে। কোভ্যাক্স সুবিধা এবং ভ্যাক্সিন সাপ্লাইসহ কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন দেশে সীমিত সরবরাহে অধিক জনস্বাস্থ্যবান্ধব একটি অগ্রাধিকার রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে এই বিশেষজ্ঞ দল। ভ্যাক্সিনেশনের এই অগ্রাধিকার রোডম্যাপ নির্দেশনাতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকাতে অন্তঃসত্ত্বা এবং প্রসূতি মায়েদের সাথে শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন জটিল রোগে ইতিপূর্বে মারাত্মক ভোগান্তিতে থাকা অন্তঃসত্ত্বা মা, প্রসূতি মা এবং শিশুদেরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের আওতাভুক্ত করার প্রস্তাবনা রয়েছে সেইজের এই নির্দেশনাতে।

গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত চিকিৎসকদের জাতীয় ফোরাম অবসটেট্রিক্যাল এন্ড গায়নিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ-ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম শুধুমাত্র গর্ভবতী এবং বুকের দুধ দানকারী মায়েদের অগ্রাধিকার টিকাদানে বিকল্প হিসেবে আলাদা অ্যাপর দাবি জানিয়েছেন। জাতীয় পরামর্শক কমিটিও ২৫ বছরের কম বয়সীদের টিকার বিষয়ে চিন্তা করছে উল্লেখ করে দ্য রিপোর্টকে তিনি বলেন, আমাদের গর্ভবতী মায়েদের বেশির ভাগই ২৫ বছরের নিচে। আবার সরকার ২৫ বছরেত নিচে পারমিশান দেননি। বাইরের অনেক দেশেই ১৮ বছর পর্যন্ত টিকা দিচ্ছে। আবার আমাদের টিকার সর্বরাহ এবং তার সাথে কোন টিকা কতো বছর পর্যন্ত দেয়া যাবে সেই বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে।

আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-সিডিসি (CDC) ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায় সেখানে নির্দেশনা যে গর্ভবতী নারীদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত এতে করোনাঝুঁকি কমবে। গর্ভাবস্থায় অন্য কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে টিকা নেয়ার কথা বলা হয়েছে সেখানে। কোনো জটিলতা না থাকলে তাদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত হবে। এতে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং মা ও শিশু নিরাপদ থাকবে।

সম্প্রতি গর্ভবর্তী নারী এবং তার পরবর্তী স্বাস্থসুরক্ষা কাজে নিয়োজিত বিশ্বের একাধিক অবস্টেট্রিক্যাল ও গাইনোকোলজিক্যাল সংস্থা গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী ব্যক্তিসহ সব যোগ্য ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ টিকা নিতে পারবেন বলে উল্লেখ করেছেন তাদের প্রস্তাবিত নির্দেশনায়। প্রায় সকল সুপারিশে ১৮ বছর পর্যন্ত টিকাদানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আমেরকিান কলেজ অব অবস্ট্রেট্রিশিয়ান অ্যান্ড গাইনকোলজিস্ট-এসিওজি, রয়েল কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ান অ্যান্ড গাইনকোলজিস্ট-আরসিওজি, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিকস-এফআইজিও, দ্য রয়েল অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ান অ্যান্ড গাইনকোলজিস্ট-আরএএনজেডসিওজি এবং ফেডারেশন অব অবস্ট্রাটিক অ্যান্ড গাইনকোলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া-এফওজিএসআই তার মাঝে উল্লেখযোগ্য।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ পরিপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে সরকার গর্ভবতী এবং বুকের দুধ দানকারী মায়েদের টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উল্লেখ করে দ্য রিপোর্টকে জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা  ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব গর্ভবতী এবং বুকের দুধ দানকারী সকল মায়েদের টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের প্রস্তাবনায় মোটাদাগে কোন বয়সের ক্যাটাগরি ছিল না। টিকা স্বল্পতার কারণে সরকার ২৫ বছরের নিচে নামছে না। কিন্তু সরকার বলেছে খুব শীগ্রই তারা তার নিচে নামবে আরও কিছু টিকা আসলে যুক্ত করেন তিনি।

Link copied!