এ কালের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে হয়তো মার্ভেল কমিকস স্রষ্টা স্ট্যানলি’র কথাই মনে হবে। কিন্তু যারা বিশ্ব সিনেমার কিছুটা হলেও খোঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে স্ট্যানলি মানেই সিনেমার ঈশ্বর, তবে নামের শেষে অবশ্যই কুবরিক থাকতে হবে। হ্যাঁ, তিনিই স্ট্যানলি কুবরিক। সিনেমার ঈশ্বর বলা হয় যাকে।
স্ট্যানলি কুবরিক ১৯২৮ সালের ২৬ জুলাই ম্যানহাটনের লাইং-ইন হসপিটালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জ্যাক লিওনার্ড কুবরিক ও মায়ের নাম জারট্রুডে। কুবরিক মারা যান ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ।
সিনেমার ঈশ্বরের ৯৩তম জন্ম বার্ষিকীতে দ্য রিপোর্ট বিনোদন টিমের আজকের এই আয়োজন।
স্ট্যানলি কুবরিকের ক্যারিয়ারের বয়স প্রায় ৫০ বছর! কিন্তু এই সুদীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে মাত্র ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার প্রায় সবগুলো সিনেমাই বিশ্ব চলচ্চিত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। শুধুমাত্র বিশ্ব চলচিত্রেই নয়, চলচিত্র নির্মানের সাথে সম্পর্কযুক্ত সবার কাছেই কুবরিকের ১৬টি সিনেমা, একেকটা যেন সিনেমার পড়াশোনার সেমিস্টার।
একটা সিনেমার গল্প কে আবেগমথিত চরিত্রের চমৎকার অভিনয়ের মাধ্যমে; অভিনয়গুলো কে ক্যামেরাবন্দী; সাথে আছে অভিভূত করা সম্পাদনার কাজ; আর আছে মুগ্ধ করা স্পেশাল ইফেক্ট দিয়ে তৈরি করা দৃশ্যরূপে পর্দায় উপস্থিত হয়ে দর্শকে এক স্বপ্নের দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। মানুষকে এ স্বপ্ন দেখাতে পারা পরিচালকের সংখ্যা কিন্তু হাতে গোনা। আর এদের মধ্যে অন্যতম স্ট্যানলি কুবরিক।
চলচ্চিত্র প্রেমীদের জন্য এই পৃথিবীকে আরো সুন্দর করার পিছনে তার অবদান উপরের দিকে। চলচ্চিত্রের বিশাল ভুবনজুড়ে স্ট্যানলি কুবরিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণের দিক থেকে, কারিগরি দিক থেকে, কিংবা চলচ্চিত্রের শৈল্পিক অবস্থান তৈরিতে কুবরিক কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা অনুধাবন করা যায়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে কুবরিকের ছোঁয়ায় বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎকর্ষতার দিক থেকে হলিউডের ছবিগুলোকে পৌঁছে দিয়েছেন অন্য উচ্চতায়।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না করা থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে পড়াশোনা না করাই ভালো!
অবাক হওয়ার কিছু নেই, এই পৃথিবীতে যারাই কিংবদন্তী হয়েছেন বেশীরভাগের কাছেই পড়াশোনা করেননি ঠিকভাবে। তাদের কাছে পড়াশুনা ভালোই লাগতো না কখনো। ভাগ্যিস তাঁদের ভালো লাগতো না, না হলে আমরা কখনই কুবরিকদের মতো কিংবদন্তী পেতাম না।
১৯২৮ সালের ২৬ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে জন্ম নিয়েছিলেন সিনেমা ঈশ্বর স্ট্যানলি কুবরিক। তিনি অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলেন না। ১৯৪৫ সালে হাইস্কুল পাস করার পর উচ্চশিক্ষা নিতে চেয়েছিলেন। হাই স্কুল শিক্ষা যখন শেষ করেন তখন আমেরিকায় মন্দা চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সেই দেশে নিয়ম করা হয়েছিল, ৬৭% এর উপর নম্বর না থাকলে কেউ কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। তাই হাই স্কুলের পর আর কুবরিকের পড়াশোনা করা হয় নি। সব মিলিয়ে তাই আর উচ্চশিক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি তার। পরবর্তীতে মন্তব্য করেছিলেন যে, স্কুল তাকে কিছুই শেখাতে পারেনি, এমনকি স্কুলের কোনকিছুতে তিনি কোনদিন উৎসাহও পাননি।
যুদ্ধোত্তর দেশের নিয়ম হয়তো আমাদের কুবরিক কে পেতে সাহায্য করেছে তবে সবচেয়ে বড় উপকারই টা করেছে তার বাবা জ্যাকব লিউনার্ড কুবরিক। ১৩ বছর বয়সে কুবরিক বাবার কাছ থেকে একটি ক্যামেরা পেয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে শখ ছিল ছবি তোলা, ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়ানোটা তার জন্য একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনা থেকে মুক্তি পেয়ে তাই বেরিয়ে পড়েন ক্যামেরা হাতে।
শুরু হয় কুবরিকের ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফি জীবন। সমাজ-বাস্তবতার শৈল্পিক রূপায়ন তার এই জীবনকে বেশ সার্থক করে তোলে, অচিরেই সেকালের বিখ্যাত ‘লুক’ ম্যাগাজিনের নজরে পড়ে যান। লুক এর জন্য তিনি পরবর্তীতে প্রায় ৫-৬ হাজার ছবি তুলেছিলেন। এই ফটোগ্রাফি জীবনই তাঁকে সিনেমা বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। লুক এর পর তার পৃষ্ঠপোষক হয়েছে হলিউডের স্টুডিও গুলো।
কুবরিক পুরো সময় জুড়ে একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, অনেকে তাকে পৃথিবীর প্রথম ‘স্বাধীন চলচ্চিত্রকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এ কারণেই কুবরিকের সিনেমায় সমাজ-সচেতনতা এবং সভ্যতার অবক্ষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আধুনিক জনপ্রিয় শিল্প এবং সংস্কৃতিকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি, এগুলোকে অবক্ষয়ের চিহ্ন হিসেবে দেখেছেন।
সিনেমার মাধ্যমে এর মর্মমূলে আঘাত করতে চেয়েছেন। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকরা সাধারণত মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম কুবরিক, যিনি মনোবিজ্ঞানের বদলে বেছে নিয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞান। কোন সিনেমার থিম মাথায় আসার পর কুবরিক গবেষণায় লেগে যেতেন। সিনেমা বানাতে প্রায় ৪-৫ বছর লাগতো, গবেষণার জন্যই বরাদ্দ থাকতো একটা বড় সময়।
কিছু উদাহরণ বলি, দ্য শাইনিং সিনেমার একটা ডায়লগের জন্য তিনদিন কিংবা একটা শটের জন্য ১২৭ দিন সময় নেয়া। সবই করেছেন শুধু মাত্র পারফেক্ট কিছু দর্শককে উপহার দেয়ার জন্য। এই জন্যেই তার সিনেমা গুলোকে ‘সিনেমা বাইবেল’ এর এক একটা অধ্যায় ধরা হয়।
স্বাধীন চলচিত্র নির্মাতা শুধু চলচিত্র নির্মানের মধ্যেই না, এমনকি কিভাবে চলচিত্র নির্মান করবেন তার মধ্যেও তিনি বরাবরই স্বাধীন ছিলেন। নিজের কাজের মধ্যে অন্যের হস্তক্ষেপও দারুণভাবে অপছন্দ করতেন তিনি। তাই ১৯৬০ সালে যখন তার অন্যতম চলচ্চিত্র ‘স্পার্টাকাস’ নির্মাণ করলেন, তখন প্রযোজক ফোরামের হস্তক্ষেপ তাঁকে বিষিয়ে দিয়েছিল।
তিনি কোনভাবেই এগুলো বরদাস্ত করতেন না, কিন্তু স্পার্টাকাসে প্রযোজকদের কথা শুনলেন এবং তা শেষবারের মত। এরপর তিনি ঘোষণা্ দিলেন যে, তাকে দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করলে লগ্নিকারদের কিংবা কারো কোনো আবদার, অনুরোধ রক্ষা করতে পারবেন না। এরপর থেকে যতোদিন বেঁচে ছিলেন, এবং সিনেমা নির্মাণ করে গেছেন; তার সিনেমায় কারো কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেননি। একেবারে স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন কুবরিক।
নির্মাণের দিক থেকে তিনি এতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন যে, তার করা প্রায় সকল সিনেমারই কাজ তিনি নিজে তদারকি করতেন। ক্যামেরা চালানো থেকে শুরু করে একেবারে নির্দেশনা পর্যন্ত সব কাজ তিনি একাই সামলাতেন। মনপুত না হলে তিনি পুনরায় কাজটি করতেন। মানে প্রি-প্রোডাকশন থেকে একেবারে পোস্ট-প্রোডাকশন পর্যন্ত সব কাজই একা একা সামলাতেন কুবরিক। কাজের বিষয়ে কোনো ধরণের ছাড় পছন্দ করতেন না তিনি।
নিজে ক্যামেরার সাথে ছোটবেলা থেকেই সময় ব্যয় করার জন্যই হোক টেকনিশিয়ান দিকে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। বর্তমান ছবিগুলোতে যে ‘ক্লোজ শট’ কিংবা ‘এক্সট্রিম ওয়াইড এঙ্গেল’ আমরা দেখি, তার আবিষ্কারক স্ট্যানলি কুবরিক। এছাড়াও নানা ধরণের শট নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষামূলক কাজ তিনি করেছেন। শুধু টেকনিক্যালি কিংবা মেকিং বিষয়ে নয়; চিত্রনাট্য, গল্প বলার ধরণ, গল্পের বিষয়বস্তু সবকিছুতেই তিনি নতুনত্ব দিয়েছেন। এইজন্যই তার ১৬টি চলচ্চিত্রই বিষয়বৈচিত্রে ভরপুর।
বিংশ শতাব্দিতে সবচেয়ে প্রভাশালী পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। তাকে চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল নির্মাতা হিসেবেও গণ্য করা হয়। কুবরিকই বোধহয় একমাত্র পরিচালক, যিনি বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যকর্মকে সবচেয়ে সফলভাবে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন।