বিশ্বে টিকার চাহিদা তুঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রে মেয়াদোত্তীর্ণের পথে লাখ লাখ টিকা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২১, ২০২১, ০১:৩০ এএম

বিশ্বে টিকার চাহিদা তুঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রে মেয়াদোত্তীর্ণের পথে লাখ লাখ টিকা

সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে ২৪ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার ৬৬৬ জন। এরমধ্যে মারা গেছে ৪৯ লাখ ৯ হাজার ৬৫৩ জন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বে টিকার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র অন্তত দেড় কোটির বেশি ডোজ নষ্ট করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) এক গবেষণায় জানা যায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দেড় কোটি ডোজ করোনার টিকা ফেলে দিয়েছে।

আরেকটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি রাজ্যে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ফেলে দেওয়া টিকার ডোজের সংখ্যা ১০ লাখ। লুইজিয়ানায় ফেলে দেওয়া ডোজের সংখ্যা ২ লাখ ২৪ হাজার। আলবামায় অন্তত ৬৫ হাজার ডোজ  টেনোসিতে অন্তত ২ লাখ ডোজ টিকা নষ্ট হয়েছে।

জানা গেছে, কিছু ডোজ নষ্ট হয়েছে ভায়াল খোলা ও সব ডোজ সম্পূর্ণ না হওয়ার জন্য। তবে ২০ হাজারের বেশি ডোজ নষ্ট হয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে। উইসকনসিনে এখনো প্রতিদিন কয়েক হাজার ডোজ টিকা নষ্ট হচ্ছে।

কয়েকমাস আগে নেদারল্যান্ডজুড়ে এরকম অনেক টিকার ডোজ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার খবর জানা যায়। স্থানীয় ডাক্তারদের জোর দাবির মুখেও এসব টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে বাইরের কোন দেশে পাঠানোর চেষ্টা করেনি দেশটির সরকার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন সময় কোটি কোটি ডোজ করোনার টিকা নষ্টের খবর প্রকাশিত হয় যখন বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ টিকার প্রথম ডোজের জন্য অপেক্ষা করছে। এই বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত দরিদ্র দেশগুলোর জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ করোনা টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছিল।

শুধু হল্যান্ড আ যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই এ ঘটনা ঘটছে। টিকা উৎপাদকদের কাছ থেকে কোটি কোটি ডোজ টিকা কিনে মজুত করে, এখন আবার সেসব টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে নষ্ট হচ্ছে। ধনী রাষ্ট্রগুলোয় টিকার চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন ফ্রিজে থেকে থেকেই নষ্ট হচ্ছে হাজারো ডোজ টিকা।

ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য আইনের সহযোগী অধ্যাপক শরীফাহ সেকালালা বলেন, ‘এটা সত্যিই দুঃখজনক যে আমাদের এমন একটি অবস্থা যেখানে টিকা নষ্ট হচ্ছে এবং আফ্রিকার অনেক দেশ তাদের জনসংখ্যার ৫ শতাংশও টিকা দেয়নি।"

তিনি আরও বলেন, ‘এশিয়ার অনেক দেশ করোনার টিকার অভাবে ভুগছে। আফ্রিকা মহাদেশে এখনও ১০ শতাংশের কম মানুষ টিকার আওতায় এসছে। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় একটি বৈষম্য’

সিডিসির মুখপাত্র ক্রিস্টেন নর্ডলুন্ড বলেছেন,এর মধ্যে অনেক করোনা টিকার ডোজ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব যারা টিকা পায়নি তাদের মধ্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাইডেন প্রশাসন করোনা টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার চেষ্টা করছে। যাতে করে যতটা সম্ভব ভ্যাকসিন অপচয় কমানো যায়।’

পেনসিলভানিয়া স্বাস্থ্য বিভাগ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছে, ‘আমরা সবসময়ই করোনা টিকা অপচয় রোধ করতে চেষ্টা করি, এবং আমরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে টিকা অপচয় করিনা।’

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের স্বাস্থ্য নীতির অধ্যাপক টিম ডোরান বলেন, ‘এটি বিশাল একটি অসমতার ব্যাপার। অনেক দরিদ্র দেশ তাদের সমগ্র জনসংখ্যার জন্য যতটা টিকা পেয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার চেয়ে অনেক বেশি ডোজ টিকা নষ্ট করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জর্জিয়া- একটা সময় করোনাভাইরাসের হটস্পট হয়ে উঠলেও ৪.৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার জন্য মাত্র ১.১ মিলিয়ন ভ্যাকসিন পেয়েছিলো দেশটি। এছাড়া নেপাল, যা করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে বিধ্বস্ত হয়, ৩০.৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার জন্য দেশটি মাত্র ৯.৭ মিলিয়ন ডোজ টিকা দিতে পেরেছে।’

টিকাদান কার্যক্রমে কিছু অপচয় থাকেই। কিন্তু মহামারীর বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচারে করোনার যেই পরিমাণ ডোজ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, সেটা আসলেই অস্বাভাবিক। কী পরিমাণ টিকার মেয়াদ ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, বা শেষের পথে আছে, সেটাও অস্পষ্ট।

পদ্ধতিগতভাবে কোথায় কত ডোজ টিকা মেয়াদোত্তীর্ণের দিকে যাচ্ছে, সেটার হিসাব রাখার জন্যও কোন অভিভাবক সংস্থা নেই। এসব তথ্য বের হয় শুধু সংবাদ প্রতিবেদন আর সরকারি বিবৃতির মাধ্যমেই।

ইসরায়েলে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত জুলাইয়ে ফাইজার-বায়োএনটেকের প্রায় ৮০ হাজার টিকার ডোজ ফেলে দেয়া হয়েছে। পোল্যান্ডে বিভিন্ন উৎপাদনকারীর প্রায় ৭৩ হাজার ডোজ টিকা নষ্ট হয়েছে। আর স্লোভেনিয়া মেয়াদোত্তীর্ণের পথে থাকা প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ডোজ স্পুটনিক ভি টিকার ডোজ রাশিয়াকে ফেরত পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু নর্থ ক্যারোলিনাতেই প্রায় আট লাখ ডোজ টিকা নষ্ট হতে চলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-র দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৯ই আগস্ট পর্যন্ত আফ্রিকায় মোট ৪,৬৯,৮৬৮ ডোজ টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। ডব্লিউএইচও-র আফ্রিকা অংশের টিকা উৎপাদন ও বিতরণ বিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড মিহিগো বলেন, 'এখানে সিংহভাগ টিকাই পাঠানো হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণের কয়েক দিন আগে।'

এই পরিস্থিতি নিয়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব স্বাস্থ্য আইনের অধ্যাপক লরেন্স গোস্টিন বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ টিকা আছে, সেটা যথেষ্ট নয়। তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারা যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য নষ্ট হচ্ছে। এই টিকাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে না। এটি পুরোপুরি একটি বিপর্যয়।'

কেন টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়?

জর্জটাউন স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক জেসি গুডম্যান জানান, মজুদকৃত অন্যান্য ঔষধের তুলনায় টিকার মেয়াদ তাড়াতাড়ি শেষ হয়। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জার ঔষধ ট্যামিফ্লু বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণ করা যায় ফ্রিজে, করোনার টিকার ক্ষেত্রে যেটা সম্ভব না।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে করোনার টিকার কার্যকারিতাও কমতে থাকে বলে জানিয়েছেন গুডম্যান। বিশেষ করে ফাইজার ও মডার্নার তৈরিকৃত এমআরএনএ টিকা বেশি দ্রুত নষ্ট হয়।

সাধারণত, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আর তা অনুমোদন দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। প্রথমদিকের টিকাগুলোয় তথ্য-উপাত্ত কম থাকায় সতর্কতাস্বরূপ মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছিল।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জনসন অ্যান্ড জনসন টিকার মেয়াদ বাড়িয়ে সাড়ে চার মাস থেকে ছয় মাস করেছে তারা। রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, তারা আশা করছেন স্পুটনিক ভি -এর মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করা হবে। এই ধরনের পদক্ষেপ টিকার অপচয় কিছুটা কমাতে পারে। 

কিছু বিশেষজ্ঞ আশা করছেন, জাতিসংঘ সমর্থিত বিশ্বব্যাপী টিকা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ 'কোভ্যাক্স', বা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টিকার ডোজগুলোকে যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা করার জন্য প্রয়োজন ধনী রাষ্ট্রগুলোর স্বদিচ্ছার, যা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না কারোর মধ্যে।

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, এনবিসি নিউজ।

Link copied!