খাপড়া ওয়ার্ড: উপমহাদেশের প্রথম জেল হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

এপ্রিল ২৪, ২০২২, ০৬:৩৮ পিএম

খাপড়া ওয়ার্ড: উপমহাদেশের প্রথম জেল হত্যা

সেদিনও বোশেখের আকাশের মধ্য গগণ থেকে সূর্য তার গনগনে আগুন ঢালছিল সমানে। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ছড়িয়ে পড়ছিল আগুনের সেই ফুল্‌কি। রাজশাহী জেলের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসা কৃষ্ণচূড়ার আগুন রাঙা সেই ডাল আর বিপ্লবী কারাবন্দিদের সোনার হাতের পরশে তখন আলো ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে! যে আলোতে চোখ ঝলসে যেতে শুরু করেছে জালিমের খড়গ কৃপাণ। কিন্তু কে জানতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহিদের রক্তে ভেসে যাবে জেলের মেঝে? যে রক্তস্রোত ফিনকি দিয়ে উপরে ফেলবে জেলের ভেতরের আরেক জেলের টালির ছাদ আর চারপাশ রক্তসুনামিতে ভাসিয়ে দেবে দেওয়াল? আজ সেই স্বর্ণালী দিন। বিপ্লবের পথে দেশমাতৃকার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া সাত সাতজন শ্রেষ্ঠ সন্তানের বলিদানের দিন। 

আজ খাপড়া ওয়ার্ড জেলহত্যা দিবস! শুধু দেশেরই নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসেরই প্রথম জেল হত্যার কালো দিন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিলের এই দিনে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট বন্দিদের ওপর নির্বিচারে সেদিন গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মারাত্মক আহত হয়েছিলেন আরও ৩২ জন। 

যদিও আমাদের কাছে খুব পরিচিত কোন দিবস নয়, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই খাপড়া জেলহত্যা দিবস। অনেক দিবসের ভীড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

কি হয়েছিল সেদিন?  

উত্তাল সেই দিনগুলোতে পাকিস্তানের সর্বত্র চলছিল মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়নের রাজত্ব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২-৩ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের) কারাগারগুলো ভরে তোলা হয়েছিল কমিউনিস্ট বন্দিদের দ্বারা। মুসলিম লীগের সেই দুর্দান্ত ও একচ্ছত্র শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াইগুলো সূচনা করেছিল কমিউনিস্টরা।

উত্তরবঙ্গে তখন চলছিল ‘তেভাগা আন্দোলন’। ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল ‘টংক আন্দোলন’। সিলেটে চলছিল ‘নানকার বিদ্রোহ’। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চলছিল দেশজুড়ে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য কমিউনিস্ট ও কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী ও প্রগতিশীল লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে চলছিল প্রচণ্ড দমন-পীড়নের স্টিম রোলার। তাদেরকে হাজারে হাজারে গ্রেফতার করে ভরে ফেলা হয়েছিল কারাগারগুলো। তাঁদের কেউ কেউ আটক ছিলেন রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে।

বন্দি অবস্থাতেও কমিউনিস্টদের সংগ্রাম বন্ধ ছিল না। নিজেদের জন্য রাজবন্দির মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা ইত্যাদিসহ অন্য সব দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি ও হাজতিদের প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধ করা, ঘানি টানার কাজ বন্ধ করা ইত্যাদি দাবিতে তারা দেশের সব জেলখানায় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। একাধিকবার একটানা দীর্ঘ অনশন কর্মসূচি পালন করেছিলেন। ঢাকা জেলে অনশনরত শিবেন রায়কে ‘ফোর্স ফিডিং’ করাতে গেলে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাজশাহী জেলেও সে আন্দোলনের ঝাপটা এসে লেগেছিল। আন্দোলন দমনের জন্য জেল কর্তৃপক্ষ কয়েকজন নেতাকে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নিলে উত্তেজনা আরও চরমে ওঠে।

এরকম এক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ২৪ এপ্রিল সকালের খাপড়া ওয়ার্ডে আসেন জেল সুপার মিস্টার বিল, দু’জন ডেপুটি জেলার, ডাক্তার, সুবেদার আকবর খাঁ। এ সময়ই বন্দিদের উপর চালানো হয় নির্বিচারে গুলি। লুটিয়ে পড়েন সাত বিপ্লবী। আহত হন আরও অনেকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের আমলে রাজশাহী জেলের ‘খাপড়া ওয়ার্ডের’ চত্বরে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। 

সেদিন ওই হত্যাকাণ্ডে যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, তারা হলেন— দিনাজপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃষক নেতা কম্পরাম সিং, খুলনার দৌলতপুরের ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী সুধীন ধর, রেল শ্রমিক নেতা দেলোয়ার হোসেন, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, আন্দামান ফেরত বিপ্লবী বিজন সেন। সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে সবিশেষ এবং সবিস্তার লেখা মেলে না। তবে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি নিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। বইটির নাম: খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০। বইটিতে ইতিহাসের এই বাঁক বদলের বহু তথ্য রয়েছে। যাদের আগ্রহ রয়েছে তারা বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। গৌরবের ইতিহাসের শিকড়সন্ধ্যানের জন্য বইটি গুরুত্বের দাবি রাখে।

তথ্যসূত্র: খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০, মতিউর রহমান। উইকিপিডিয়া। 

ছবি: গুগল

Link copied!