ডিসেম্বর ১৩, ২০২১, ১০:৪২ পিএম
আর মাত্র দুই দিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় গোটা জাতির মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরাও গর্বিত। তবে তারা চিন্তিত স্বাধীনতা লাভের এত দিন পরও জাতি কেনো চেতনার প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্ত। সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনে তারা শঙ্কিত। তবে সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা তাদের।
শহীদ মিনারের বেদীতে আলতাফ মাহমুদ-এর নেতৃত্বে একুশের গান। ছবি: সংগৃহীত
সুরকার, সংস্কৃতিকর্মী, ভাষাসৈনিক ও এবং শহিদ দিবস নিয়ে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ অমর গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদের সন্ধান পাওয়া যায়নি ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টের পর। তার একমাত্র মেয়ে শাওন মাহমুদ মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে অর্থনৈতিক মুক্তি ও ব্যাপক উন্নয়ন হলেও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনও গড়ে উঠতে পারেনি।
দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে দেওয়া সাক্ষাতকারে শাওন বলেন, “স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া। এটি নিঃসন্দেহে জাতির সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। এই বিচারের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম চাওয়া পূরণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।”
তবে যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেসব লক্ষ্যের সবগুলো এখনও পূরণ হয়নি বলে তিনি মনে করেন। শাওন মাহমুদ বলেন, “সরকার এখনও রাজাকারদের তালিকা তৈরি করতে পারেনি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকাও চোখে পড়ে না। রাজাকারদের পাশাপাশি আলবদর বাহিনীর সদস্যদের তালিকাও তৈরি হয়নি। এসব করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে জাতির মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তির সুযোগ থাকতো না।”
বাংলাদেশে এখনও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার ঘটনা বেদনাদায়ক উল্লেখ করে শাওন বলেন, “শুধু আমার বাবা না, সব মুক্তিযোদ্ধাই চেয়েছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। পাশাপাশি দেশটি হবে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের মধ্যে আমরা আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছি; এগুলো ভাল খবর। তবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাঝে মাঝে চোখ রাঙাচ্ছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়।”
দেশের পাঠ্যপুস্তকে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজির মতো ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা’ নামে আলাদা একটি বিষয় রাখার দাবি জানিয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর হয়ে গেছে। তৃণমূলে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। তথ্যগুলো বের করার জন্য এখনও সময় আছে। প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের পরীক্ষা চালু করতে হবে। এর জন্য প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক একটি বই পাঠ্যসূচির তালিকায় রাখতে হবে। তারা শুধু খণ্ডিত ইতিহাস পড়বে কেনো? ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানাতে হলে এর বিকল্প নেই।” পাশপাশি অসাম্প্রদায়িক শক্তির শিকড় উপড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
স্বাধীনতার এতদিন পরেও আমাদের সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দ্বিধা বিভক্ত বলে মনে করেন আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর।ছবি: সংগৃহীত
তৌহিদ রেজা নূর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বিংহ্যামটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার। টেলিফোনে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে তৌহিদ রেজা নূর বলেন, “স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দ্বিধা বিভক্ত থাকলেও ভাল খবর হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারা বের হয়ে আসছে। তবে এখনও লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আর এই লড়াইটা হলো অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনার সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।”
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯৭১ সালে ইত্তেফাকে কাজ করেছেন। 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন। তিনি প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন কনস্যুলেটের গোপন প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন। পরে এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে থেকে বারবার প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন 'ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়' নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। এই লেখায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “যে দোষে শেখ মুজিবকে দোষী বলা হচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকরা সেই একই দোষে দুষ্ট“। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাকে রাজধানীর চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর লোকেরা। তারপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যেসব অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলণ্ঠিত করেছে বলে মনে করেন তৌহিদ রেজা নূর।
তৌহিদ বলেন, “পচাত্তরের পট পরিবর্তনের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথমবার সরকার গঠনের পর দেশ আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে বিশাল পাওয়া।”
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের শেষের দিকে এমনকি বিজয় দিবসেও বৃদ্ধিজীবীদের হত্যা করে রাজাকার ও আলবদরের সদস্যরা। পরবর্তীতে খুনিদের অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। পলাতক ওইসব খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এ এফ এম আব্দুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা, নুজহাত চৌধুরী।ছবি: সংগৃহীত
শহীদ ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী ছিলেন চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী। ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তার বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং সারারাত নির্যাতনের পর ভোররাতে মেরে ফেলে। বিজয় দিবসের দুই দিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত লাশের সন্ধান মেলে।
ডা. নুজহাত, বাবা শহীদ আবদুল আলীম চৌধুরী এবং মা শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আলিম চৌধুরীসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে চৌধুরী মঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
আজও খুনিদের ফাঁসির সেই রায় বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, “দেশ স্বাধীনের পরপরই মইনুদ্দীন আর প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। চৌধুরী মঈনু্দ্দীন বর্তমানে লন্ডন আর আশরাফুজ্জামান নিউ ইয়র্কে রয়েছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেল। অথচ আজ পর্যন্ত তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বিচারের রায় কার্যকর করা গেলো না।”
ডা. নুজহাত চৌধুরীও বিশ্বাস করেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও মৌলবাদী গোষ্ঠী, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও সাম্প্রদায়িক শক্তি মাঝে মাঝে তাদের শক্তি প্রদর্শন করে।
রাজাকারদের তালিকা প্রস্তুতের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা দ্রুত সময়ে শেষ করে দেশব্যাপী তা টাঙানোর দাবি জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. নুজহাত।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি প্রথম দফার তালিকায় ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম রয়েছে। চলতি বছরের গত ২৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ওই তালিকা ঘোষণা করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় দফার তালিকা তৈরির কাজ চলমান।
সারাদেশে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা টাঙানো হবে বলে বারবার বলা হলেও এখনও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন অ্যাপস তৈরি করতে আইসিটি মন্ত্রণালয়কে এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন নাম-পরিচয় দেওয়া হবে, তেমনটি একাত্তর সালের রাজাকার, আলবদর, আল শামসদেরও নামের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। যেন আগামী প্রজন্ম তাদের কুকৃর্তির কথা জানতে পারে।”
প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে বাংলা ও ইংরেজির মতো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক বই রাখা এবং এই বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষার ব্যাপারে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী বলেন, “এই বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তারা সিদ্ধান্ত নিলে হতে পারে।”