দিন দিন ঢাকার বাতাস দূষিত হওয়ার পর এখন বিষাক্ত হয়ে চলেছে। ঢাকার অন্তত ডজন খানেক এলাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ শহরতলীর বাতাসে জরিপ করে অতি নানা ক্ষুদ্র বিষাক্ত কণ্যা মিলেছে। এরমধ্যে প্লাস্টিক কণা অন্যতম। ঢাকাবাসীর নিশ্বাসের সঙ্গে ওই কণা শরীরে প্রবেশ করছে। এতে ক্যানসার, শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগ তৈরি হচ্ছে, যা ওষুধেও দূর হবে না বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা।
জরিপ বলছে, গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বাতাস দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে চলেছে। চলতি বছরের প্রথম মাসেও বায়ু দূষণ ও বিষাক্ততা অব্যাহত রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা একিউএয়ারের তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে একদিনের জন্যও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে উঠে আসতে পারেনি ঢাকার বাতাস। বরং মাসের বেশ কয়েকদিনই ঢাকার বায়ুমান ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিষাক্ত প্লাস্টিকের কণা।
একিউএয়ার জানাচ্ছে, গত ৫ জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ১৫৭ একিউআই সূচকে পৌঁছালেও ১৮ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৬ দিন এই মান ছিল ২০০-এর কাছাকাছি। এর মধ্যে ২২ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ২৭৯-তে পৌঁছায়। এরপর ২৪ জানুয়ারি বৃষ্টি শুরু হলে ঢাকার একিউআই-ও কিছুটা কমে আসে। তারপরও এই বায়ুমান ১৭০-এর নিচে নামেনি। অর্থাৎ বৃষ্টি সত্ত্বেও ঢাকার বায়ুমান এক দিনের জন্যও স্বাস্থ্যকর অবস্থায় ফিরে আসেনি।
চলতি ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হয়েছে আরও দুর্যোগময় বায়ু দূষণের মাত্রা দিয়ে। আজ রবিবার সকালে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল বিশ্বে সর্বোচ্চ। এই ধারা সারাদিন অব্যাহত ছিল। বিকেল পাঁচটায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বায়ুর মান ছিল চরমদূষণের। এ সময় একিআই ছিল ৩৮৮!
প্রসঙ্গত, বায়ুমানের ক্ষেত্রে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক তথা একিউআইয়ের মান ৫০ পর্যন্ত হলে তাকে স্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত থাকলে তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ধরা হয় যদিও ব্যক্তি বিশেষে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত মাত্রাকে বলা হয় অরেঞ্জ লেভেল যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা ক্ষতিকর না হলেও কারো কারো স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই মান ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত চরম অস্বাস্থ্যকর।
একিউআই ৩০০-এর বেশি হলে সেটিকে বিপর্যয়কর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে হিসেবে ঢাকার বায়ুর মান জানুয়ারি মাসে কোনোদিনই ১৫০-এর নিচে নামেনি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর বায়ু পায়নি রাজধানী শহরে বাসিন্দারা। চলতি ফেব্রুয়ারিতেও ওই ধারা অব্যাহত আছে। গত পাঁচদিনের একদিনও বায়ুর মান স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে আসেনি। বরং এটি দুর্যোগমাত্রায় চলে গেছে।
সরকারি তরফে পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ু দূষণ রোধে সম্প্রতি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায়। কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার তৎপরতা দেখা যায়নি।
ঢাকার বায়ু দূষণ নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘মূলত তিনটি কারণে জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ুমান খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। প্রথমত, গত ডিসেম্বরে মেট্টোরেলের উদ্বোধনের কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। ফলে গত ৭ বছরের মধ্যে ডিসেম্বরে বায়ু মান সবচেয়ে ভালো ছিল। খোঁড়াখুঁড়ির কাজও ওই সময় বন্ধ ছিল। জানুয়ারির শুরুতে এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে ১০০টি জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়।’
দ্বিতীয়ত কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে বায়ু দূষণ বাড়ে। ডিসেম্বরে উল্টো গরম পড়েছে। জানুয়ারির শুরু থেকে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এতে প্রতিবেশী দেশ থেকে দূষিত বাতাস এসেছে। পাশাপাশি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটাও নেওয়া হয়নি।’
এই বিশেষজ্ঞের মতে তৃতীয়ত কারণ হলো, ‘জানুয়ারিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২ কিলোমিটারের মতো। ফলে দূষিত বায়ু নিম্নস্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তাই নগরবাসীকে পুরো মাসজুড়েই দূষিত বায়ু গ্রহণ করতে হয়েছে।’
এদিকে ঢাকার দূষণে নতুন মাত্রা দিয়েছে বাতাসে খুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের নগরগুলোতে গত দেড় যুগে প্লাস্টিকের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। রাজধানীতে বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। এই প্লাস্টিকের প্রায় অর্ধেক মাটি ও পানিতে রয়ে যায়। তৈরি করে মারাত্মক দূষণ। জনস্বাস্থ্যকে ফেলে হুমকিতে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাতাসে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা ভেসে বেড়ানো একটি নতুন তথ্য। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ এবং নিরাপদ স্থানে ফেলার দায়িত্ব নেয়, সে বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’