সেপ্টেম্বর ২, ২০২২, ১১:০৬ পিএম
রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদ-নদী, বাতাস ও মাটি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খেলার মাঠ-পার্ক থেকে শুরু করে বসবাসের জন্য সর্বশেষ বাড়িটুকুও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেছে। এ যেন এক বিশৃঙ্খল মহাশহর। এরপরও প্রতিনিয়ত মানুষ জীবিকার টানে গ্রাম ছেড়ে এই শহরের দিকেই ছুটছেন। এতে ভবনগুলোর তলা বেড়ে বহুতল হচ্ছে, খেলার মাঠগুলো কমছে, কমছে পার্কও। এভাবে শহরটি মানুষের বসবাসের নূন্যতম যোগ্যতাও হারাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চেষ্টা করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ জন্য তারা দীর্ঘদিনের যাচাই-বাছাই শেষে নগর নিয়ে সংশোধিত একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) দিয়েছে। নতুন এই ড্যাপের গেজেটের অনুমোদনও দিয়েছে সরকার।
রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, সরকারের শীর্ষ মহলের সুনির্দিষ্ট, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চাপ সামলে সংশোধিত ড্যাপ বাস্তবায়ন করলে ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকা ও এর আশেপাশে একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জনঘনত্ব। দ্বিতীয়তঃ জলাশয় ঠিক রেখে উন্নয়ন কাজ পরিচালনাকেও আমলে নেওয়া হয়েছে।
ড্যাপ সংশোধনীতে সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, নগরপকিল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, এনজিও, সুশীল সমাজের মতামত নেওয়া হয়েছে। ১৩০টি অংশগ্রহণমূলক সভা, ৮৩০টি লিখিত মতামত গ্রহণ এবং এক হাজার ৩০টি প্রশ্নমালা দিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।
সংশোধিত ড্যাপে যা রাখা হয়েছে
নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহার উৎসাহকরণ: ভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকাসহ কৃষি, প্রাতিষ্ঠানিক, জলাশয়, বনাঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান, যোগাযোগ, বন্যা প্রবাহ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব: নগর পরিকল্পনায় জনঘনত্ব কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনঘনত্বের বিষয়টি অনুপস্থিত থাকায় বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এবারের গেজেটে জনঘনত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে ড্যাপে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
জলাশয় এবং নৌপথের সমন্বয়ে ব্লু নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা: ড্যাপের পরিকল্পনায় নদী, খালসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের সমন্বয়ে নৌচলাচলের পথ (ব্লু নেটওয়ার্ক) প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। সড়কপথের পাশাপাশি উপেক্ষিত জলপথকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক ৫৭৪ কিলোমিটার নৌ-চলাচলের উপযোগী নৌপথ উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা করা হয়েছে। প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে ২৩টি খাল উন্নয়ন প্রকল্প সুপারিশ করা হয়েছে যা দখলমুক্ত এবং সংস্কার করে নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে।
নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থা ও সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিতকরণ: ঢাকার মোট জনসংখ্যার বিরাট অংশ এই শ্রেণির। নিম্নবধ্যবিত্তের আবাসনের ব্যবস্থার বিপরীতে প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে শহরের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ উপকৃত হবে। এই শ্রেণির সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থার লক্ষ্যে পরিকল্পনায় ৫৭টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতি: নগর এলাকায় জায়গার স্বল্পতার কারণে প্লটভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে অপেক্ষাকৃত কম জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান রেখে এবং অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট প্লট একত্রীকরণে একদিকে যেমন বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট ইমারত নির্মাণ করা যাবে। অন্যদিকে নির্মাণ খরচ কমবে। এতে শহরের নিচু ও কৃষি জায়গা সুরক্ষা পাবে।
সড়ক, নৌ ও রেল পথসহ গণপরিবহন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান: ড্যাপে সড়কপথ, নৌপথ এবং রেলপথকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঢাকার সাথে আশেপাশের শহরকে যুক্ত এবং যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে ৬টি মেট্রো, ২টি বিআরটি, ৬টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-ময়মনসিং রোডের সমান্তরালে ২টি প্রধান সড়ক, ২টি রিংরোড, রিংরোডের সঙ্গে সংযুক্ত রেডিয়াল রোড এবং বৃত্তাকার নৌপথের প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকার চারদিকে মোট ১৩টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল এবং ২টি টার্মিনালের প্রস্তাব করা হয়েছে। মেট্টো স্টেশন, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও নদীবন্দর কেন্দ্র করে সংলগ্ন এলাকায় ট্রানজিটভিত্তি উন্নয়ন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচলে অগ্রাধিকারমূলক নির্দেশনা: পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচলের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২০২ কিলোমিটার সাইকেল লেন রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চলের ধারণ ও স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তাবনা: যারা যে এলাকায় বাস করবেন, তাদের ছেলেমেয়েরা সেই এলাকার স্কুলে ভর্তি হবে। এই ধারণাকে নগরপরিকল্পনার ভাষায় বলা হয় বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চল ধারণা। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রতিটি এলাকার সুষম উন্নয়নে এবং যানজট নিরসনে অঞ্চলভিত্তিক মানসম্মত ৬২৭টি বিদ্যালয়, ২৮৫টি কলেজ এবং ২৮৭টি হাসপাতালের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রতিটি অঞ্চলে বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক নির্মাণ: একটি পরিবেশবান্ধব শহরের জন্য যে পরিমাণ পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার, ঢাকা মহানগর অঞ্চলে তার তুলনায় খুবই স্বল্প পরিমাণে বিদ্যমান আছে। ভৌত জরিপ থেকে দেখা যায়, ঢাকায় মোট উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ মোট এলাকার মাত্র ০.৯ শতাংশ, যা খুবই নগণ্য। উন্মুক্ত স্থান, পার্ক, বন ইত্যাদি সবুজায়নের উদ্যোগ পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্রের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পনায় ৫টি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক, ৫৫টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ১৩টি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ) এবং ১৩টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামানুসারে কেরানীগঞ্জে প্রায় ৪২৫ একর জায়গা নিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ড্যাপে পুরান ঢাকার বিভিন্ন সাইট চিহ্নিত করে ‘আরবান রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভূমির পুনঃউন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে এই এলাকায় মৌলিক সুবিধাদির ব্যবস্থা করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী বিদ্যমান রাসায়নিক গুদাম পর্যায়ক্রমে স্থানন্তরের সুপারিশ করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে পুরো ঢাকার জন্য সাংস্কৃতি বলয় তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্লাবন ভূমি ব্যবস্থাপনা: প্লাবনভূমি এলাকাকে বিচ্ছিন্ন স্বত্বা না ভেবে বরঞ্চ পানি এবং ভূমির সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করা। প্লাবনভূমি যুগোপযোগী ব্যবহার করতে হবে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা: পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে আগামী পাঁচ বছর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করার সুপারিশ করা হয়েছে ড্যাপে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, নতুন ড্যাপে মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পুরনো ঢাকাসহ ঢাকার আশেপাশের এলাকায় বেশ পরিবর্তন আসবে। নতুন ড্যাপ সরকারের অনুমোদন পাওয়ায় অনেক হাউজিং কোম্পানি নাখোশ হয়েছে। যেকোনো নিয়মে সব মানুষকে সমানভাবে খুশি করা যায় না। ড্যাপের গেজেট আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাবে।
এদিকে নতুন ড্যাপ কার্যকরের আগে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়ার সংখ্যা হঠাৎ অনেক বেড়ে যেতে দেখা গেছে। রাজউকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংস্থা থেকে সাধারণত বছরে গড়ে চার হাজারের মতো ভবন নির্মাণের অনুমোদন হয়। কিন্তু চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৫৬টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক।