শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি এড়াতেই বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ৭, ২০২২, ০৯:৪১ এএম

শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি এড়াতেই বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি!

শ্রীলংকার মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার কোনও ইঙ্গিত নেই দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ বাংলাদেশে। তবে গত শুক্রবার মধ্যরাতে  বাংলাদেশ সরকার পেট্রোপণ্যের দাম এক ধাক্কায় ৩০-৪০ টাকা বাড়ানোয় দেশটিতে আর্থিক সঙ্কটের ইঙ্গিত স্পষ্ট বলেই মনে করছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের অনেকে। তাদের অভিমত, শ্রীলংকার মতো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যাতে না হয় তার জন্য বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।

শ্রীলংকার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের এপ্রিলের গোড়ার দিকে শ্রীলংকায় আর্থিক সঙ্কটের সূচনার প্রাথমিক বার্তাও এসেছিল জ্বালানির তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমেই।

চীনের কাছ থেকে পাওয়া তহবিলপুষ্ট প্রকল্প আর ঋণগ্রহণে ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকার তা নিয়ে প্রথমে তেমন গুরুত্ব দিতে চায়নি।

কিন্তু অচিরেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি আর গণপরিবহণের ভাড়ার হার বাড়তে থাকায় তৈরি হয় জনবিক্ষোভ।

এর পর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শ্রীলংকার জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘সিলোন পেট্রলিয়াম পেট্রলের দাম এক ধাক্কায় ৮২ টাকা এবং ডিজেলের দাম ১১১ টাকা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে।

দেশটির জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়কমন্ত্রী কাঞ্চনা উইজেসাকারা জানিয়েছিলেন, বিপুল লোকসান সামাল দিতেই বাধ্য হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

শুক্রবার বাংলাদেশ সরকার  লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা এবং ডিজেলের ৩৪ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা করে একই যুক্তি দিয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক দফতরও।

গতকাল শুক্রবার হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ সরকার। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। এখন এক লিটার ডিজেল কিনতে ১১৪ টাকা লাগছে। এক লিটার অকটেনের জন্য গুনতে হচ্ছে ১৩৫ টাকা। আর প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ১৩০ টাকা।   

শুক্রবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জ্বালানি তেলের নতুন এই দর জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে নতুন এই দর কার্যকর হবে।

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। তাতে দাম হয়েছিল ৮০ টাকা লিটার। তার আগে এই দুই জ্বালানি তেলের দাম ছিল লিটারে ৬৫ টাকা।

দাম বাড়ার কারণ ব্যাখ্যায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রিতে ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে যৌক্তিক মূল্য সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হবে।

বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) বলছে, গত ছয় মাসে পেট্রোপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকারও বেশি লোকসান করেছে। তা সামলাতেই মূল্যবৃদ্ধি।

শেখ হাসিনা সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘‘নিরুপায় হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল আমরা।’’

পেট্রোল-ডিজেলের পাশাপাশি বাংলাদেশে পরিবহণ ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত অকটেনের (গ্যাসোলিন জ্বালানি) দামও লিটার প্রতি ৪৬ টাকা বেড়েছে।

আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাচক্রে, মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রীলংকার মতোই জ্বালানি তেলে ‘রেশনিং’ ব্যবস্থাও চালু হয়েছে বাংলাদেশে। মোটরবাইক এবং গাড়ি-পিছু সর্বোচ্চ কত লিটার জ্বালানি কেনা যাবে, তা নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে।

শ্রীলংকার আর্থিক সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে বিপুল অঙ্কের বিদেশি ঋণকে চিহ্নিত করেছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশও অনেক বিদেশি ঋণ নিয়েছে। ঘটনাচক্রে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে ঢাকার বিদেশি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় চার লাখ কোটি টাকা।  এই ঋণ বর্তমানে দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩২৩ কোটি ডলারে। বাংলাদেশি মৃদ্রায় এর পরিমাণ সাড়ে আট লাখ কোটি টাকা!

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ শোধ করতে গেলে বাজারে চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই এখনই রাজকোষ রক্ষায় সতর্ক না হলে তেলের বাজারের আগুন দেশের অর্থনীতিতে গ্রাস করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলের অনেকে।

আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রশংসা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলংকার রাজাপক্ষের মতো কখনওই রাজকোষ শূন্য করে জনমোহিনী রাজনীতি করেননি হাসিনা। তাই তাঁর পক্ষে অনেক দৃঢ় ভাবে আর্থিক পরিস্থিতির হাল সামলানো সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন।

তাঁদের মতে, এমনটাও হতে পারে যে পরিস্থিতি যাতে শ্রীলংকার মতো না হয়, তার জন্য আগেভাগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সঙ্কটের মোকাবিলার মতো অর্থ থাকবে সরকারের কাছে।

Link copied!