সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের শেষের দিকে মেট্রোরেলে চলাচল করতে পারবেন ঢাকাবাসী। সেই লক্ষেই দ্রুত গতিতে নির্মাণ কাজের পাশাপাশি মেট্রোরেলে যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে গণপরিবহনে প্রভাব পড়েছে। এর প্রভাব মেট্রোরেল খাতেও পড়বে। তবে মেট্রোরেল ও নগর পরিবহনের যাত্রীসেবা সমন্বয় করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোরেল নিয়ে ২০১৬ সালে ৩ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, অন্যান্য গণপরিবহনের ভাড়ার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে মেট্রোরেলে যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। রুট এবং আরোহণের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হবে।
রাজধানীর সায়দাবাদ, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান ও মতিঝিল ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহনে আগে সায়দাবাদ থেকে মিরপুর-১০ নম্বর পর্যন্ত প্রত্যেক যাত্রী ৩০ টাকা ভাড়া দিয়েছিলেন। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রত্যেক যাত্রীকে ৪৫ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। জ্বালানি তেল ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন সংকট ছাড়াও বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে দৈনিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিন চলছে। জ্বালানির ঘাটতি মেট্রোরেলের ওপরও পড়বে।
জানা যায়, জ্বালানির দাম বাড়ায় গণপরিবহনে যে ভাড়া বেড়েছে, মেট্রোরেল এটি সমন্বয় করবে। কারণ মেট্রোরেল বাণিজ্যিকভাবে চলবে। সেখানে বিদ্যুৎ বিল, কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ, বৈদেশিক ঋণ সব মিলে দৈনিক মেট্রোরেলে পরিচালনা ব্যয়ে প্রায় ২.৩৩ কোটি টাকা লাগবে। তিন তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার। সেখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে পাঞ্চ করলেই খুলে যাবে সংক্রিয় দরজা। পরে এস্কেলেটর বা সিঁড়ি দিয়ে তৃতীয় তলা প্ল্যাটফর্মে ওঠা যাবে। আর সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে মেট্রোরেল। তবে টিকিট ছাড়া যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে উঠতে পারবে না। অতিরিক্ত পথ ভ্রমণ বা কোনোভাবে টিকিট ছাড়া মেট্রোরেলে ভ্রমণ করলে, প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। টিকিটের মূল্যের সঙ্গে জরিমানা গুণতে হবে যাত্রীকে।
মেট্রোরেলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, মেট্রোরেল উদ্বোধনের আগমুহূর্তে ভাড়ার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এতে মেট্রোরেলের ভাড়া নিয়ে গেজেটে যা বলা হয়েছে, সেটা অনুসরণ করা হবে। কারণ গণপরিবহনের সাথে মেট্রোরেলের যাত্রীদের ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। এ ইস্যু নিয়ে ইতোমধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি মতিঝিলে শেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন কাঠামো দৃশ্যমান হয়। এরপর পিলারে বসানো স্প্যানের ওপরে বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো হয়েছে। কারণ বিদ্যুতে চলবে মেট্রোরেল। ইতোমধ্যে দিয়াবাড়িতে ১৩২ কেভি উপকেন্দ্র স্থাপন হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তুত নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের দরকার হবে। এটি বিদ্যুতের গ্রিড লাইন থেকে সরবরাহ করা হবে। এতে বিদ্যুৎ সরবারহ করবে ডিপিডিসি, ডেসকো। আর তত্ত্বাবধায়নে থাকবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
জানা গেছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বিদ্যুতের সংযোগ সম্পন্ন হয়েছে। ফার্মগেট, বিজয় স্বরণী ও কাওরানবাজার সহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর কাজ চলমান। মেট্রোরেলের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন করছে জাপানের মারুবেনি ও ভারতের এল অ্যান্ড টি। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড- ডেসকো ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলি বলেছিলেন, ‘আমাদের অধীনে যতটুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা এরইমধ্যে তা করা হচ্ছে। আমাদের সরবরাহ করা বিদ্যুৎ দিয়েই এখন মেট্রোরেলের ট্রায়ালসহ যাবতীয় কাজ হচ্ছে।’
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. মশিউর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, মেট্রোরেলে প্রাপ্তবয়স্ক, শিশু, বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের আলাদা আলাদা ভাড়ার বিষয়টি নির্ধারণে আলোচনা হয়নি। বিমানে শিশুদের বয়সভিত্তিক টিকিট প্রয়োজন হয়। যেমন ০-২ বছরের শিশু, ২-১২ বছরের কম শিশু-ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মূল্য হয়ে থাকে। বিমানের নিয়ম অনুসরণ করে শিশুদের টিকিট নির্ধারণ করা হবে মেট্রোরেলে। আর বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের টিকিটের মূল্যের বিষয়ে সরকার যে নির্দেশনা দেবে তা মানা করা হবে।
এর আগে ২২ আগস্ট ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে মেট্রোরেলে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুরুতে উত্তরা-আগারগাঁও অংশে চলবে ট্রেন।
১০টি ট্রেন দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিন ১০ মিনিট পরপর ট্রেনগুলো চলবে। তারপর জনগণ একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয় দিন হয়তো এ সময়টা সাত মিনিট এবং ক্রমান্বয়ে সময় আরো কমিয়ে আনা হবে। সময় কমিয়ে আনার বিষয়টি ১০ দিনও লাগতে পারে। ১৫ দিনও লাগতে পারে। এটা নির্ভর করবে ব্যবহারকারীদের ওপর। যদি অনেক বেশি মানুষ মেট্রোতে যাতায়াত শুরু করেন, তাহলে চেষ্টা করব সাড়ে তিন মিনিট পর পর ট্রেন চালানোর। তবে প্রথম দিন বা প্রথম কয়েকদিন ১০ মিনিট পর পর ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্য উল্লেখ এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, এমআরটি লাইন ৬-এর সার্বিক অগ্রগতি ৮১ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি ৯৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের অগ্রগতি ৮১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগামী বছরের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে জুনে মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে সকাল ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটারে মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশে ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে।