অক্টোবর ২৩, ২০২২, ০৮:০৮ এএম
দীর্ঘ ২৫ বছর পর রবিবার (২৩ অক্টোবর) নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন হচ্ছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে জেলার নেতৃত্বে নতুন মুখ কে আসছে, ত্যাগী নেতারা কি মূল্যায়িত হবেন, নাকি অবহেলার শিকার হবেন— এরকম নানামুখী আলোচনা এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর দ্বন্দ্বের কারণে এবারের কমিটিতেও গণমুখী, সৎ, আদর্শবাদী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের না-ও দেখা যেতে পারে। অথচ এরা দুজন সম্মিলিতভাবে হাল ধরলে নারায়ণগঞ্জে অন্য কোনো দল আওয়ামী লীগের সামনে দাঁড়াতে পারতো না।
ইতিমধ্যেই জেলা শাখার ত্রিবার্ষিক এই সম্মেলনের জন্য শহরের পৌর ওসমানী স্টেডিয়াম মাঠে তৈরি করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছেন তা নিয়েই চলছে মূলতঃ আলোচনা। পাশাপাশি এবারও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হবে কিনা, তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
জেলা শাখা কমিটির সভাপতি হিসেবে সবচাইতে বেশি আলোচিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের নাম। বর্তমান সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভীর নামও আলোচনায় আনছেন নেতাকর্মীরা। এদের মধ্যে সেলিনা হায়াৎ আইভী বর্তমান কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং জেলা শাখা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আব্দুল হাই। ছবি: সংগৃহীত
এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মমতাজ হোসেন, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আব্দুল কাদিরের নামও সভাপতি পদের আলোচনায় এসেছে।
জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনা রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু, আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দীপু, জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ভোটের মধ্যে হবে, নাকি কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হবে— তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে যোগ্য ও কর্মীবান্ধব রাজনীতিকদের নেতৃত্বে আনার দাবি তুলেছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু। ছবি: সংগৃহীত
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আগের সম্মেলনগুলোর চাইতে এবারের ত্রি- বার্ষিক সম্মেলনের প্রস্তুতি অনেক ভালো। সাংগঠনিকভাবেও ভালো অবস্থায় আছি। আমাদের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকেই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বানাবেন, তাঁদের নেতৃত্বেই আমরা কাজ করব।
এবারও নিজে সভাপতি প্রার্থী জানিয়ে আবদুল হাই আরও বলেন, আমার উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে নেত্রী আমাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমাকে ফের সভাপতির দায়িত্ব দিলে আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।
আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু। ছবি: সংগৃহীত
নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর সর্বশেষ কাউন্সিল অধ্যাপিকা নাজমা রহমান সভাপতি ও এমপি শামীম ওসমান সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।
পরবর্তীতে সম্মেলন ছাড়াই ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর আবদুল হাইকে সভাপতি, নাসিক মেয়র মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী সহ-সভাপতি এবং আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদ বাদলকে সাধারণ সম্পাদক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট জেলার আংশিক কমিটি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। কেন্দ্রের এ ঘোষণার ১৩ মাস পর জেলা ৭৪ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন দলের জন্য নিবেদিত ও ত্যাগী অনেক নেতাকর্মী। দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও এসব নেতাকর্মী এখন আর কমিটিতে নেই। এদের একজন নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেড় যুড়ের যুগের বেশি সময় ধরে দেখলে মনে হয় আওয়ামী লীগ দল হিসেবে গতি, গৌরব ও রূপ শতকরা ১০০ ভাগই হারিয়ে ফেলেছে। এক সময় দলটির তৃণমূলে ছিল গণমুখী-সৎ, আদর্শবাদী ও অভিজ্ঞ রাজনীতির পরীক্ষিত মুখ; সেখানে আজকের চিত্রপট একেবারেই ভিন্ন। এখন আর দলে পরীক্ষিত, ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নেই। তাই দল ও সরকারকে আলাদা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কতটা সফলতা অর্জন করেছে তাঁর বিষয়ে আলোচনার সময় এসেছে।
নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস (সাধারণ সম্পাদক) এবং জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: সংগৃহীত
জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ কাঁপানো তোলারামপুর কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক এই জিএস (সাধারণ সম্পাদক) আরও বলেন, বর্তমানে অনেকে আছেন যাঁরা আজন্ম আওয়ামী লীগ করেছেন, তবে দলীয় নেতৃত্ব ও ক্ষমতার স্বাদ পাননি। অন্যদিকে উড়ে এসে জুড়ে বসে ষোলো-আনাই ভোগ করে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছেন অনেকে।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেকের সাংগঠনিক দক্ষতা-অভিজ্ঞতা থাকলেও দলে আজ তাঁদের জায়গা নেই। সমন্বয়হীনভাবে চলছে দল। গণমুখী কর্মীবান্ধব সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ আজ সরে গেছে।
জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাবেক এই নেতা বলেন, দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি, জেলে গিয়েছি, পুলিশের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি সততা আর নিষ্ঠার সাথে। রবিবার ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল, অথচ আমাকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।
জেলা শাখা আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দল আর রেষারেষি রয়েছে স্বীকার করে সাবেক এই নেতা আরও বলেন, শামীম ওসমান আর আইভী হায়াৎ এক হলে জেলায় অন্য কোনো দল দাঁড়াতে পারে না। তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি দলকে আজ নাজুক অবস্থানে নিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। রাজপথে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো মাঠে নামার চেষ্টা করছে তাতে আমাদের দরকার শক্তিশালী নেতৃত্ব।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আইভীর সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দলেও কোনো বিভেদ নেই। জেলায় আওয়ামী লীগ মানেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। আমাদের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
আপনি নিজে প্রার্থী কিনা—এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে সম্মেলন সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডকে বলেছি, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ত্যাগীদের মূল্যায়ন চায়। যাঁরা সারাজীবন আওয়ামী লীগ করে আসছেন, শত বাধা সত্ত্বেও দলের হয়ে কাজ করেছেন, তাঁরাই যেনো নেতৃত্বে আসেন। কারণ তাঁরাই তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বকে মূল্যায়ন করতে পারবেন, সম্মান দিতে পারবেন। আর রাজপথও কাঁপাতে পারবেন তাঁরাই।
সম্মেলন সম্পর্কে শামীম ওসমান বলেন, নারায়ণগঞ্জে হবে স্মরণকালের অন্যতম সম্মেলন। তৃণমূল হলো জেলা শাখা আওয়ামী লীগের অক্সিজেন।
সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।