ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত পাঁচ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর তিনদিন পর আট আগস্ট শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। বঙ্গভবনে তাদের শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেদিনের শপথ অনুষ্ঠানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও।
সেদিন সবকিছু ঠিকঠাক মতো হলেও এরপর ধীরে ধীরে আওয়াজ উঠতে থাকে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। এখানে সেই দাবিতে রাজপথ সরগরম। ঘেরাও করা হচ্ছে বঙ্গভবন। মিছিল, মিটিং আন্দোলন চলছে।
তবে রাষ্ট্রপতি বা বঙ্গভবনের তরফ থেকে তার পদত্যাগের বিষয়ে এখনো কিছুই জানানো হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- মো. সাহাবুদ্দিন যদি নিজে থেকে পদত্যাগ না করেন, তাহলে তাকে কি অপসারণ করা সম্ভব! এই অন্তর্বর্তী সরকার কি পারবে, তাকে সরিয়ে দিতে?-এসব প্রশ্নই এখন ঘুরছে সবার মনে।
অবশ্য সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। রোববার দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, এমন কোনো দালিলিক প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমি শুনেছি যে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
মানবজমিনের প্রতিবেদন প্রকাশের পরই রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে নানা আলোচনা–সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রপতির সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন। গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি সেটা গ্রহণ করেছেন। এখন আড়াই মাস পর বলছেন, তাঁর কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নেই। এমন কথা বলা স্ববিরোধিতা।
আরও পড়ুনঃ শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে: রাষ্ট্রপতি
আসিফ নজরুল দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন, যা শপথ ভঙ্গের শামিল। তার বক্তব্যে অটল থাকলে, তিনি পদে থাকতে পারেন কিনা তা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচিত হতে পারে।
কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ কি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারবে? বাংলাদেশের সংবিধানে অবশ্য এমন ক্ষমতা দেয়া হয়নি। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী শুধু মাত্র সংসদই পারে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর ভেঙে দেয়া হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। ফলে সংসদের সেই সুযোগ আর নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৫২, ৫৩ ও ৫৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলা আছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সংসদ কার্যকর থাকতে হবে। সংসদ সদস্যরাই কেবল রাষ্ট্রপতি অপসারণ বা অভিসংশন করার ক্ষমতা রাখেন। আবার রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন এবং তিন মাসের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করতে হবে।
সংসদ ভেঙে দেয়ার পর স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার রয়েছেন কারাগারে। তাই রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে চাইলেও, সেটি এখন আর সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আনজীবী শাহদীন মালিক মনে করছেন, এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি উঠলেও, সেটি সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয়।
তার মতে, ‘রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তার পদত্যাগেরও সুযোগ নেই। সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর, সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর।
বরং জন আকাঙ্ক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে শাহদীন মালিক বলেন, ফুটবল খেলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ফাউল, হ্যান্ডবল, পেনাল্টি, কিছুই নেই। তাই বলে কি গোল হবে না? গোল কীভাবে হবে, সেটা তো নির্ধারিত হতে হবে।
সব মিলিয়ে দেশে এখন আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সবকিছুই বাতিল করা যেতো। কিন্তু তা না করে, কোনোটি বাদ দেয়া হয়েছে- আবার কোনোটি রাখা হয়েছে বলেই এই জটিল পরিস্থিতি সামনে এসেছে।
হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটি লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এর দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট নিজেই বর্তমান সরকারকে শপথ করিয়েছেন। সরকার তাকে সংসদ ছাড়া অভিশংসন করলে বা বাদ দিলে এখন হয়তো কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে তো আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা উঠতে পারে।
অভ্যুত্থানের পরপরই আন্দোলনকারী সব দল, শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে আগের সব বাতিল করে দিলে বর্তমানের এই সংকট তৈরি হতো না বলেও মনে করেন হাফিজুর রহমান কার্জন।
এদিকে রাষ্ট্রপতিকে সমালোচনা করলেও তার অপসারণ বা পদত্যাগ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। বিএনপি দলীয়ভাবে সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মন্তব্য না করার পরামর্শ দিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী শুধু বলেছে, ‘রাষ্ট্রপতি অসত্য বক্তব্য দিয়ে ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।