একের পর এক জ্বালানির জাহাজে আগুন নিয়ে শঙ্কা

বিশেষ প্রতিবেদক

অক্টোবর ১৪, ২০২৪, ০৭:০২ পিএম

একের পর এক জ্বালানির জাহাজে আগুন নিয়ে শঙ্কা

একের পর এক জ্বালানির জাহাজে আগুন নিয়ে শঙ্কা ।

মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে জ্বালানি বহনকারী চারটি জাহাজে আগুন লেগেছে। এরমধ্যে একটির আগুন শুরুতে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তিনটি জাহাজ পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে জ্বালানি বহনকারী জাহাজে একের পর এক আগুনের ঘটনায় নানা মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নাশকতার উদ্দেশ্যে আগুন লাগানো হচ্ছে কিনা তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

আর চার জাহাজের ঘটনা বিশেষ করে এলপিজি বহনকারী বিদেশি জাহাজে আগুন ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে জাহাজ পাঠানো নিয়েও ভাবিয়ে তুলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ঘটনায় নিহত হন তিনজন।

বাংলার জ্যোতি সরকারি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) মাদার ভেসেল থেকে তেল সরবরাহ করতো। 

এর চারদিন পরই বিএসসির আরেকটি জাহাজ বাংলার সৌরভে আগুন লাগে। সেদিন নিহত হন একজন। বাংলার সৌরভও মাদার ভেসেল থেকে তেল নিয়ে যেত রিফাইনারিতে।

দুই জাহাজে আগুনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটে আরেক ভয়াবহ কাণ্ড। গত শনিবার রাতে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় এলপিজি বহনকারী দুটি জাহাজে আগুন লাগে।

এরমধ্যে মাদার ভেসেল ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ বিদেশি মালিকানাধীন এবং লাইটারেজ জাহাজ ‘সোফিয়া’ দেশীয় মালিকানাধীন।

এলপিজি বহনকারী দুই জাহাজে ভয়াবহ আগুনের পর ১২ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ৩১ ক্রু প্রাণ বাঁচতে সাগরে ঝাঁপ দেন। পরে একটি টাগবোট তাদের উদ্ধার করা হয়।

চার জাহাজে তিনটি আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কেনো এই আগুন তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি ইআরএলের জন্য অপরিশোধিত তেল আমদানি করতো। বাংলাদেশের পেট্রোলিয়ম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন এই কারখানাটি গত অর্থবছরের ১৩ লাখ টনের মতো জ্বালানি তেল পরিশোধন করেছে।

আর মাদার ভেসেল থেকে সব থেকে ইআরএলের কারখানায় বহন করে নিয়ে যেতো জ্যোতি ও সৌরভ। চারদিনের ব্যবধানে দুটি জাহাজই পুড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ায়, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে এই তেল এখন কীভাবে আনা হচ্ছে?

বিপিসির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, কীভাবে তেল আসবে সেই চিন্তা আমাদের না। আমাদের চুক্তি বিএসসির সঙ্গে। জাহাজর ব্যবস্থা করবে তারা।  

ওই কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে বিপিসি দেশের বাইরে থেকে একটি লাইটারেজ জাহাজ ভাড়া করে ইআরএলে তেল সরবরাহ শুরু করেছে, যে জাহাজটির ধারণক্ষমতা জ্যোতি ও সৌরভের সম্মিলিত ক্ষমতার থেকেও বেশি।

দুই জাহাজে আগুন লাগার পর গত পাঁচ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আগুনের ঘটনায় জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টায় নাশকতা হতে পারে বলে।

আবার গত শনিবার এলপিজি বহনকারী দুটি জাহাজে আগুন লাগার পর এই সন্দেহ ফের সামনে এসেছে।

দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজে ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করা আতিক ইউ খান নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২৫ বছর বিদেশি জাহাজে ছিলাম। খুবই উঁচুমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল এবং সেভাবে মেইনটেইন করা হত। ১২ দিনের মধ্যে পরপর ৪টা জাহাজে অগ্নিকাণ্ড আর বিস্ফোরণ নিঃসন্দেহে খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা।

আর এভাবে ক্রমাগত বিশেষ করে বিদেশি জাহাজ আগুনের ঘটনা জাহাজ ব্যবসায়ীদের ভাবিয়ে তুলবে বলে মনে করছেন ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ ওয়াদুদ খান।

তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এখন অনেকটা এলজিপি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এলপিজিও যদি আমদানি করা সম্ভব না হয়, ওই যে বললেন, বাইরের লোকের আত্মবিশ্বাসের অভাব। চট্টগ্রাম পোর্টের ইমেজও নষ্ট হচ্ছে। অনেকে আছেন, জাহাজ পাঠাতে চাইবে না।

ওয়াদুদ খান বলেন, বিস্ফোরণ আর আর আগুন, সবকিছুতেই তিনটা উপাদান লাগে। ওরমধ্যে তেল থাকতে হবে, অক্সিজেন বা এয়ার এবং হিট বা তাপ থাকত হবে।

আরও পড়ুন : এলপিজিবাহী জাহাজে অগ্নিকাণ্ড: ৮ সদস্যের তদন্তে কমিটি গঠিত

জাহাজে আগুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নাবিকদের মধ্যেও। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, আমাদের চারটা লোক মারা গেছেন। আপনি জাহাজ কিনতে পারবেন, আনতে পারবেন। জবাবদিহিতা করতে পারবেন। কিন্তু এই লোকগুলোকে তো আর ফরিয়ে আনতে পারবেন না।

‘যারা মারা গেছেন, তাদের বিভাষিকাময় মৃত্যু হয়েছে। যখন বিস্ফোরণ হয়, তখন ৮০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রি তাপ তৈরি হয়। মোট কথা আপনি ঝলসে যাবেন,’ বলেন। এইসঙ্গে নিরাপত্তা ও তদারকি বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

দেখুন : নিরাপত্তা কম জেনেই জলদ‍‍`স্যুরা জাহাজ টার্গেট করে

Link copied!