মে ১৯, ২০২৫, ০১:৪২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
‘বিয়ারিং ফেইলিওর বা কাজ না করার’ কারণে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটির চাকা খুলে পড়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে চাকা খুলে পড়ার এই কারণ তুলে ধরেছে বিমান।
তবে কী কারণে ‘বিয়ারিং ফেইলিওর’ হয়েছিল, সেটি তদন্তের পর জানা যাবে বলে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য। চাকা খুলে পড়ার এই ঘটনায় নিরাপত্তা ও তদন্তে বিমান কর্তৃপক্ষ দুইটি কমিটি গঠন করেছে।
সোমবার, ১৯ মে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বিমান।
ঘটনা পর্যালোচনা করে বিমান কর্তৃক্ষ বলছে, কানাডার ডি-হেভিল্যান্ড এয়ারক্রাফট কোম্পানির তৈরি ড্যাশ-৮ ৪০০ মডেলের বিমানটির চাকার বিয়ারিং ত্রুটি দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট চাকা অথবা টায়ার ‘বিচ্যুত হতে পারে’, যা সেদিন ঘটেছে।
এছাড়া ইতোমধ্যেই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারিগরি টিম পাঠানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ বিমান। তাতে সাড়া দিয়ে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তাদের বিশেষায়িত দলটি ঢাকায় আসছে এ দিন।
গত ১৬ মে কক্সবাজার থেকে দুপুর দেড়টার দিকে উড়তে শুরু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ‘বিজি-৪৩৬’ ফ্লাইটটি। ওড়া শুরুর পরেই দেখা দেয় বিপত্তি; খুলে পড়ে বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারের পাশের একটি চাকা। ওই ফ্লাইটে ৭১ জন যাত্রী এবং দুইজন ক্রু ছিলেন।
ফ্লাইট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহ, যার প্রায় আট হাজার ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার সঙ্গে ছিলেন ফার্স্ট অফিসার জায়েদ। পাইলট ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তাৎক্ষণিক বিষয়টি জানান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টারে।
এরপর ফ্লাইটটি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, ইমার্জেন্সি প্রটোকলসহ সব ব্যবস্থা নেওয়া হয় রানওয়েতে। এর মধ্যে দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণ করে। উড়োজাহাজটি নির্দিষ্ট পার্কিং বে-তে পৌঁছানোর পর প্রকৌশলীরা বাম দিকের ল্যান্ডিং গিয়ারের একটি চাকা (দুই নম্বর) না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পরে খুলে পড়া চাকাটি পাওয়া যায় কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ায়। উড়োজাহাজটি ছিল কানাডার ডি-হেভিল্যান্ড এয়ারক্রাফট কোম্পানির তৈরি ড্যাশ-৮ ৪০০ মডেলের।
বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চাকা খুলে পড়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ছড়াও সতর্কতার বিষয়ে এবং উড়োজাহাজটি ফের ওড়ানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বিমানের কাছে মনে হয়েছে, “চাকাটি বিয়ারিংয়ের ত্রুটি বা ফেইলিওরের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। উড়োজাহাজটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ডি-হেভিল্যান্ড কর্তৃক প্রণীত রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানুয়ালের টাস্ক সূত্র ০৫-৫০-১৭-২১০-৮০১ অনুযায়ী, চাকার বিয়ারিং ফেইলিওর হলে, সম্পূর্ণ চাকা বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে উল্লেখ আছে। তবে, বিয়ারিং ফেইলিওরের সঠিক কারণ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রদানের পর জানা যাবে।”
অবতরণের পর বিমান প্রকৌশল বিভাগের তাৎক্ষণিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকায় অবস্থানরত সবগুলো ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজের সবগুলো চাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
নিরাপত্তা ও তদন্তে কমিটি ২টি
এ ঘটনায় প্রেক্ষিতে ২টি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিমান। এর মধ্যে চিফ অব ফ্লাইট সেফটির নেতৃত্বে তিন সদস্যের ‘সেফটি ইনভেস্টিগেশন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া প্রকৌশল ও ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট পরিদপ্তরের আওতায় তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
তদন্ত কমিটি এই ঘটনার মূল কারণ অনুসন্ধান করবে। এাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের শর্ত ও রেকর্ডগুলো পরীক্ষা এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পরামর্শও দেবে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে বলেও জানিয়েছে বিমান।
ফের উড়বে উড়োজাহাজটি
উড়োজাহাজটিকে আবার যাত্রীসেবায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
“উড়োজাহাজটির প্রস্তুতকারকের কাছে ঘটনাটি রিপোর্ট করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে। উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উড্ডয়নের জন্য উড়োজাহাজটিকে যাত্রীসেবার জন্য উপযুক্ত বলে ঘোষণা করা হবে।”
বিমানের ভাষ্য, “এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনা মোকাবিলার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বৈমানিকদের নিয়মিত সিমুলেটর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।”
ফ্লাইট ক্রু ট্রেনিং বা টেকনিক ম্যানুয়াল ৮ দশমিক ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে টেকঅফ করা বিমানবন্দরে পুনরায় অবতরণ না করে গন্তব্যের বিমানবন্দরে অবতরণের বিষয়ে বৈমানিককে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহ সম্পূর্ণভাবে পালন করে ঢাকায় অবতরণ করেছেন।”
ক্যাপ্টেন বিল্লাহ সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের ‘সফল প্রয়োগ’ দেখিয়েছেন বলে বিমানের ভাষ্য।
বিজ্ঞপ্তিতে বিমান বলছে, ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজের অন্যতম প্রধান ব্যবহারকারী বিমান সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে বর্তমানে ৩১টি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ রয়েছে। গত তিন বছরে এর ধরনের চারটি ঘটনা ওই বিমান সংস্থায় ঘটেছে।
ডি-হেভিল্যান্ডের বরাতে ‘ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ এয়ারক্রাফট’কে ‘অত্যন্ত নিরাপদ উড়োজাহাজ’ বর্ণনা করে বিমান বলছে, “ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজে ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত চাকা সংশ্লিষ্ট মোট ৫৯টি ঘটনা ঘটেছে।
“এই উড়োজাহাজটির ল্যান্ডিং গিয়ার সিস্টেমে রিডান্ডেন্সি আছে। কাজেই একটি চাকা অপ্রত্যাশিতভাবে অকেজো থাকলে তা ফ্লাইট সুরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। সাধারণত যে কোন বানিজ্যিক বিমানের ডিজাইনের সময় ফ্লাইট সেফটি সম্পর্কিত প্রতিটি যন্ত্রাংশ বা সিস্টেমের নিরাপদ অপারেশন নিশ্চিতকল্পে রিডান্ডেন্সি বা ব্যাক-আপ থাকে।”
একইভাবে ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজের প্রতিটি ল্যান্ডিং গিয়ারে দুইটি করে চাকা থাকে। যাতে কোনো কারণে যদি একটি চাকা বিকল হয় বা একটি চাকার সমস্যা হয়, তাহলেও জরুরি অবস্থায় উড়োজাহাজটি নিরাপদে অবতরণ করতে পারে বলে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।