কারফিউ-১৪৪ ধারা-জরুরি অবস্থার পার্থক্য

হাসনাত আসিফ কুশল

জুলাই ২৮, ২০২৪, ০৭:০০ পিএম

কারফিউ-১৪৪ ধারা-জরুরি অবস্থার পার্থক্য

কারফিউ চলাকালীন রাজধানীতে সেনা টহল। ছবি: সংগৃহীত

কারফিউ, ১৪৪ ধারা, জরুরি অবস্থা। এই শব্দগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ খুব কমই পরিচিত। অনেকে এগুলোর পার্থক্য বোঝেন না। অনেকে মনে করেন কারফিউ, ১৪৪ ধারা, জরুরি অবস্থা সমার্থক শব্দ। অথচ আভিধানিকভাবে সেটা সঠিক ধারণা নয়।

সম্প্রতি কোটা আন্দোলন চলাকালীন সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ জুলাই মধ্যরাতে দেশ জুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। এরপর গতকাল রাতে রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত (২৮-৩০ জুলাই) ১১ ঘণ্টা কারফিউ শিথিলের খবর নিশ্চিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

জনসাধারণকে কারফিউ, ১৪৪ ধারা ও জরুরি অবস্থার মধ্যে পার্থক্য বোঝাতেই দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের আজকের এই আয়োজন-

কারফিউ

কারফিউয়ের অপর নাম সান্ধ্য আইন। এটা এমন একটা আইন যেটা কোনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষ কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। সোজা কথায় কারফিউ বা সান্ধ্য আইন হলো সন্ধ্যা কিংবা সন্ধ্যার পর নাগরিকদের চলাফেরার ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়মকানুন।

বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে কারফিউ শব্দটির উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কারফিউ বা সান্ধ্য আইন শব্দটি ইংরেজি হলেও প্রকৃত অর্থে সেটা ফরাসি ভাষার শব্দ couvre-feu (ক্যুভর-ফ্যু) থেকে এসেছে। couvre-feu (ক্যুভর-ফ্যু) শব্দের অর্থ অগ্নি নিবার্পণ বা ঘরের প্রদীপ নেভানোর হুকুম। উইলিয়াম দি কনকরার বলেছেন, শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো, “কাঠের বাড়ি-ঘরে জ্বালানো অগ্নিশিখা ও আগুনের প্রদীপ থেকে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য রাত আটটার ঘণ্টা বাজার মধ্যেই সব আগ্নিশিখা ও আগুনের প্রদীপ নিভিয়ে ফেলার নিয়ম।”

অভিধান অনুযায়ী কারফিউ হলো বিশেষ্য। অক্সফোর্ডের অভিধানে এর অর্থ বলা হয়েছে, কোনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনও স্থানের জনসাধারণকে ঘরে থাকার নির্দেশনা।

কারফিউ
ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

আধুনিক সময়ে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি হলে সবাইকে বাড়ির অভ্যন্তরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। এই কারফিউ দেওয়ার কারণ হলো, ঘরের বাইরে জমায়েত হয়ে কোনও সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আবার কোনও অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা করতে না পারে।

কারফিউ কি সেটা জেনে আসতে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের এই প্রতিবেদন পড়ে দেখতে পারেন: কারফিউ কি?

কারফিউ-পুলিশ
ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

২৬ জুলাই দ্য রিপোর্ট ডট লাইভে প্রকাশ হওয়া ওই প্রতিবেদনে কারফিউ বা সান্ধ্য আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, জনগণের প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন কোনও স্থানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ৪ জনের বেশি মানুষকে একত্রে জমায়েত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সান্ধ্য আইন বা কারফিউ জারি করা হয়। সান্ধ্য আইন অনুযায়ী কোনও কোনও জায়গায় রাতে, আবার কোনও জায়গায় দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। কখনও কখনও অল্প সময়ের ব্যাবধানে কারফিউ প্রত্যাহার কিংবা শিথিল করা হয়, যাতে মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী কেনাবেচা, ব্যবসায়িক লেনদেন বা যাতায়াত সম্পন্ন করতে পারে।

১৪৪ ধারা

১৪৪ ধারা হলো ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির একটি ধারা। ভারত ও বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি ১৪৪ ধারা এক ও অভিন্ন।

এই ধারা আইনের ক্ষমতাবলে কোনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনও এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ, আগ্নেয়াস্ত্র বহনসহ যেকোনও কাজ নিষিদ্ধ করতে পারেন। জরুরি অবস্থা বা সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই আইনের প্রয়োগ করা হয়।

১৪৪ ধারা

অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় প্রাপ্ত আইনি ক্ষমতার অপপ্রয়োগও করা হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার বাঙালির উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এদেশের তদানীন্তন ছাত্র-জনতা সেটা মানতে চায়নি। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিকেলের সামনে মিছিল নিয়ে যায়। পুলিশ ওই মিছিলে গুলি চালালে সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-বরকত-অহিউল্লাহসহ আরও অনেকে শহীদ হন।

প্রতিবেশী ও মিত্র দেশ ভারতে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি দিল্লির জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি ও আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। এই বিক্ষোভ দমনে কেন্দ্রীয় সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।

১৪৪ ধারা ও কারফিউয়ের পার্থক্য

১৪৪ ধারা ও কারফিউয়ের মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ১৪৪ ধারা হলো ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির একটি ধারা। এই আইনের ক্ষমতাবলে কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনও এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ করা, আগ্নেয়াস্ত্র বহনসহ যেকোনও কাজ নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার রাখেন।

অন্যদিকে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন হলো সন্ধ্যা কিংবা সন্ধ্যার পর নাগরিকদের চলাফেরার ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়মকানুন। যাতে ঘরের বাইরে জমায়েত হয়ে কোনও সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আবার কোনও অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা করতে না পারে। এখানে একটি কথা বিবেচ্য যে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ও ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কার্যকলাপকে ‘বেআইনি সমাবেশ’ বলা হয়।

জরুরি অবস্থা

জরুরি অবস্থা হচ্ছে এমন পরিস্থিতি যা স্বাস্থ্য, জীবন, সম্পত্তি বা পরিবেশের তাৎক্ষণিক ঝুঁকি তৈরি করে। বেশির ভাগ জরুরি অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে দ্রুত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। যদিও কিছু পরিস্থিতিতে ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে পরবর্তীতে শুধু উপশমকারী পরিষেবা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে এক-এগারোর শুরুতে ও ২০২৩ সালে তাপমাত্রাজনিত কারণে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

জরুরি অবস্থা

বিশিষ্টজনদের মতে, জরুরি অবস্থা জারির জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে যেকোনও একটি ঘটনা ঘটলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

  • জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি বা পরিবেশের ওপর তাৎক্ষণিক হুমকি এলে;
  • প্রাণ নাশ, স্বাস্থ্যের অবনতি, সহায়-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বা পরিবেশের ক্ষতিসাধন হলে;
  • বর্ধিত আকার ধারণ করে জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি বা পরিবেশের ক্ষতির বিস্তর সম্ভাবনা থাকে।

জনজীবনে বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য কখনও কখনও কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করা হয়ে থাকে। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা এলাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে জারি হয় ১৪৪ ধারা। আর কোথাও জরুরি অবস্থায় প্রাণ নাশ এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

নিকটঅতীতে জরুরি অবস্থার উদাহরণ

রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে বহুবার কারফিউ, ১৪৪ ধারা ও জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তুমুল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে নাশকতা ও সহিংসতা চরম আকার ধারণ করে, তখনই জারি করা হয়েছে কারফিউ, ১৪৪ ধারা ও জরুরি অবস্থা।

বাংলাদেশের নিকটঅতীতের জরুরি অবস্থা জারির একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বেশ ভালোভাবে আপনি বুঝতে পারবেন। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মঈন উ আহমেদের জারি করা জরুরি অবস্থা। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে কেন্দ্র করে সংকটের ‍শুরু।

বিগত জোট সরকারে শাসনামলে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ দাবি করতে থাকে যে, বিচারকদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার দুরভিসন্ধিতেই এই সংশোধনী আনা হয়েছে। এ ছাড়া তদানীন্তন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ ছিল যে কে এম হাসানকে বিচারপতি করার মধ্য দিয়ে বিচারকদের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। কিন্তু জোট সরকারে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনও কথাই শুনলেন না।

নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে (২৮ অক্টোবর) ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশজুড়ে শুরু হলো অরাজকতা। এই অরাজকতা যেমন রাজপথে জনসাধারণকে ভুগিয়েছিল, তেমনই তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকেও কূটনৈতিকভাবে অপদস্থ করেছিল।

২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পদত্যাগের পর কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান করেন ইয়াজউদ্দিন। কিন্তু বিচারপতি কে এম হাসান এই দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

উপায়ন্তর না থাকায় এবং বিরোধী ও কূটনীতিকদের চাপ উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আওয়ামী লীগ কিন্তু এখনও রাজপথে রয়েছে। এ-অবস্থার মধ্যেই অভিযোগ ওঠে, অদৃশ্য কারও কথায় প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন ওঠাবসা করছেন। রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন ইয়াজউদ্দিন। ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাত্রা শুরু করে। অস্থিতিশীলতা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মঈন উ আহমেদ ও ফখরউদ্দিন আহমেদের সেই সরকার শুরুতেই জরুরি অবস্থা জারি করেন। এ ছাড়া ফখরউদ্দিন-মঈন উ আহমেদের শাসনামলে একাধিকবার ‘স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে’ কারফিউ বা সান্ধ্য আইন ও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল।

Link copied!