মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি হারাচ্ছেন শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ২১, ২০২৫, ০৪:৫৬ পিএম

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি হারাচ্ছেন শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতা

বদলে যাচ্ছে ১০ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদ (এমএনএ ও এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি হারাচ্ছেন। তাদের নতুন পরিচয় হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধনের চূড়ান্ত খসড়ায় এ পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে।

এ আইনের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা ব্যক্তিরাই কেবল বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। রাজনীতিবিদসহ আরও চার শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাকে নতুনভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।

’মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ পরিচয় পাবেন যারা 

আইনের খসড়া অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে—

১. প্রবাসী পেশাজীবী সংগঠক: মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন।

২. মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে যারা কাজ করেছেন, যেমন কূটনীতিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য সহায়ক কর্মী।

৩. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও সাংবাদিক: যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণায় ভূমিকা রেখেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের তথ্য প্রচার করেছেন।

৪. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য যারা বিভিন্ন দেশে খেলে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

বদলে যাচ্ছে ১০ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এই খসড়া আইন কার্যকর হলে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধার তালিকার প্রায় ১০ হাজার স্বীকৃত ব্যক্তির মর্যাদায় পরিবর্তন আসবে। তাদের পরিচয় হবে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী। এতে শুধু রাজনীতিবিদ নয়, বেসামরিক গেজেটে থাকা আরও কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামও পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে জানান, “রাজনীতিবিদরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকবেন না। বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল তারাই থাকবেন, যারা অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের সুযোগ-সুবিধা মুক্তিযোদ্ধাদের সমানই থাকবে।”

সমালোচনা ও পুনর্বিবেচনার দাবি

বিশিষ্টজনরা এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আইন পরিবর্তন করে ইতিহাস বদলানো সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের ভূমিকা মুছে ফেলার চেষ্টা অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত।”

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার না করে বরং দেশের অর্থনীতির দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের তাকানো উচিত।

মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ কেবল সামরিক যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল জনযুদ্ধ। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংগ্রাম এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে গণপরিষদের সদস্যদের বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।”

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হারুন হাবীব বলেন, “এই পরিবর্তন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভ্রান্ত করবে। মুক্তিযুদ্ধ জাতির ইতিহাসের মীমাংসিত সত্য, এটি নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করা ঠিক নয়।”

এদিকে, সরকার ইতোমধ্যে খসড়া আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছে। মন্ত্রিসভা অনুমোদনের পর এটি অধ্যাদেশ হিসেবে কার্যকর হবে। এরপর নতুন নিয়ম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই শুরু হবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটির তালিকার ভিত্তিতে এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম পাঁচটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলেও, সেটি গেজেটভুক্ত হয়নি। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারিত হয় ৭০ হাজার ৮৯২।

পরবর্তীতে, ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তৈরি তৃতীয় তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ হাজার। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে প্রকাশিত চতুর্থ তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯-এ। ২০২৩ সালে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ষষ্ঠ দফার চূড়ান্ত (সমন্বিত) তালিকা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হয় ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১, যার মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ১০ হাজার ৯৯৬ জন।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর, গত ১৪ আগস্ট নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই ও প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে অমুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার পরিকল্পনা থাকলেও, পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় বিদ্যমান আইন সংশোধন করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়।

বদলে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা

১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের সময় প্রণীত সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, ‘যে কোনো ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।’

পরবর্তীতে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর এক গেজেটের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণ করা হয় এবং এর পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। পরবর্তীকালে এটি জাতীয় সংসদেও পাস করা হয়। নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’

এ সংজ্ঞায় রণাঙ্গনের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রবাসে পেশাজীবী সংগঠক, ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত নারী (বীরাঙ্গনা), মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসা সেবাদানকারী চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

তবে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা সংশোধনের উদ্যোগ চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। খসড়ায় পরিবর্তিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থ—যেসব ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রাম ও শহরে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন এবং অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যারা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, সেই সকল বেসামরিক নাগরিক এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনীর সদস্য, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে, তবে তাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সসীমার মধ্যে থাকতে হবে।’

এছাড়া, খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞাও সংশোধন করা হয়েছে। নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘“মুক্তিযুদ্ধ” অর্থ—১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ।’

বর্তমান আইনের সংজ্ঞায় বলা রয়েছে, ‘“মুক্তিযুদ্ধ” অর্থ—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার পর, দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল।’

Link copied!