বিবিসির বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মোড়, সতর্ক নজর ভারতের

সোহেল তারেক

মার্চ ১৯, ২০২৫, ০১:৫২ পিএম

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মোড়, সতর্ক নজর ভারতের

ছবি: সংগৃহীত

গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নাটকীয় পরিবর্তনের পর থেকে একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করেছে। দুই দেশের সাম্প্রতিক এই ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিশেষ নজরে রয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড় এবং সেই বিষয়টি ভারত কীভাবে দেখছে সেই বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এতে বলা হয়েছে, কয়েক দশকের বৈরী সম্পর্ক কাটিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরাসরি বাণিজ্য শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে বিমান ও সামরিক যোগাযোগ পুনরায় শুরু হয়েছে এবং ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। নয় মাসব্যাপী সেই যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছিল এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এরপর ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক উষ্ণ থাকলেও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর তা আবার শীতল হয়ে যায়।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, হাসিনা ছিলেন দিল্লির আস্থাভাজন, আর একারণেই তিনি ইসলামাবাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেছেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক জটিল ছিল। তবে এখন তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।’ অন্যদিকে, এই পরিবর্তনকে ভারত সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কেও টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ সরকার তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে এবং তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। তবে ভারত এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের এই কৌশলগত মেলবন্ধন ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি কৌশল হতে পারে। পাকিস্তানি একাডেমিক লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো আয়েশা সিদ্দিকা যেমনটা বলেছেন যে, ‘পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একসাথে ভারতের প্রভাব মোকাবিলার চেষ্টা করছে।’

সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ছাড়াও দুই দেশের সম্পর্কে আরও কিছু বিষয়ে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছেন। সামরিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। জানুয়ারিতে একটি উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশি সামরিক প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফর করে এবং দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সাথে আলোচনা করে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে করাচিতে পাকিস্তান আয়োজিত বহুজাতিক নৌ মহড়ায় বাংলাদেশি নৌবাহিনী অংশ নেয়।

ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি, যিনি ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন, তিনি এই পরিস্থিতিকে ‘ডেজা ভু’ বলে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, তার দায়িত্বকালীন সময়ে ভারত বাংলাদেশে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এমনকি প্রমাণও হাজির করেছিল।  

যদিও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছিল। ভারত আশঙ্কা করছে, নতুন এই ঘনিষ্ঠতা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।

কেননা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে। ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করা তুলনামূলকভাবে সহজ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, সরকার এই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালায় এবং তাদের ঘাঁটি ধ্বংস করে। 

এসব কারণে বীণা সিক্রি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের পুনরুজ্জীবনকে “ভারতের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ” বলে মনে করছেন।

তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “এটি শুধু সামরিক সম্পর্ক নয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করছে, বিশেষ করে জামাত-ই-ইসলামীর মতো দলগুলোর সঙ্গে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামাবাদের পক্ষে ছিল।”

সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে কিছু খবর এসেছে যেখানে দাবি করা হয়েছে যে শীর্ষ আইএসআই কর্মকর্তারা ঢাকায় সফর করেছেন। যদিও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সেই দাবিগুলো জোরালোভাবে প্রত্যাখান করা হয়েছে।

পাশাপাশি, যেসব প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বাংলাদেশে একটি ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ক্যাম্প পুনরায় চালু করতে কাজ করছেন, সেগুলোকে “ভিত্তিহীন” বলা হয়েছে। 

এদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের ভবিষ্যতে আইএসআই-এর ভূমিকা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ সম্পর্কে বিবিসির প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি। 

অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কাছাকাছি আসছে। বর্তমানে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ৭০০ মিলিয়ন ডলারের কম হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে তা বাড়তে পারে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন ঢাকা সফরে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন সরকার বৈদেশিক নীতিতে নতুন কোনো দিক নির্ধারণ করতে পারে।

তবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ-সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান জরুরি। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধকালীন গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়েছে, তবে ইসলামাবাদ এখনো সেই উদ্যোগ নেয়নি।

এমনকি পাকিস্তানের একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ইকরাম সেহগালও স্বীকার করেন যে, “দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রধান বাধা হলো বাংলাদেশের এই দাবি যে পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।”

তবে অবসরপ্রাপ্ত এই পাকিস্তানি সেনা মেজর মনে করেন যে বাংলাদেশেরও উচিৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাভাষীদের দ্বারা উর্দুভাষীদের ওপর চালানো হামলার বিষয়টি স্বীকার করা। 

এমন পরিস্থিতিতেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিকরা জানেন যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও ভাষাগত সম্পর্কের কারণে ঢাকা কোনোভাবেই ভারতবিরোধী অবস্থান নিতে পারবে না।

যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি ভারতকে অনেকটাই বিপাকে ফেলেছে। একে ভারতের জন্য ঝুঁকি বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। কারণ দেশটি মনে করে, উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য।

Link copied!