দীর্ঘ চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন যে অবশ্য প্রয়োজন সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। অনেক কারণেই এই সংস্কার অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্ত সব কিছু কি রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব। কোথায় সংস্কার, কেন পরিবর্তন, কিভাবে বদল হওয়া দরকার সেটা বোঝাও প্র্রয়োজন। বদলে ফেলার চেয়ে বেশি দরকার সেই সংস্কার বা পরিবর্তন সত্যিকার অর্থেই হয় গণমানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতির শুদ্ধির জন্য হচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা।
রাজনীতি বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনেক কিছুই বদলাতে হবে সময়ের প্রয়োজনে, তাকে রক্ষার আয়োজনে এবং একবোরে নষ্ট না হয়ে না যাওয়ার প্রয়োজনে। পরিবর্তন আনতে হবে দলের ভেতরে ও বাইরে। সংস্কার প্রয়োজন মানসিকতারও।
দুর্নীতি এবং দুর্নাম-মুক্ত করতে প্রথমেই বদল আনতে হবে রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের প্রক্রিয়ায়। ভাবতে হবে একটা দল কিভাবে চলবে, টাকা কিভাবে আসবে এবং কিভাবে খরচ হবে। যারা রাজনীতি করবেন তাদের উপার্জনের উপায় এবং ব্যয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে।
ভাবতে হবে কিভাবে সব কিছু স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করা যায় সেটা নিয়ে। গলদ কোথাও না কোথাও আছে। কোথায় গলদ, কিভাবে এবং কেন সেটা ভয়াবহতার দিকে চলে গেল সেটা বোঝার চেষ্টা আর এর থেকে বের হবার উপায় খোঁজা। না হলে সবই ভেস্তে যেতে পারে। ভাবতে হবে কিভাবে রোধ করা যাবে পতন, পচন অথবা মরণ।
রাজনৈতিক সংস্কার কি রাজনীতির সংস্কার, রাজনীতিবিদদের সংস্কার, দলের নাকি ব্যক্তির। রাজনীতির সাথে একজনের যুক্ত হবার প্রক্রিয়া, কেন তিনি রাজনীতি করবেন, রাজনীতি করে কি করবেন, কিভাবে চলবে দল, কিভাবে চলবে তার সংসার সব কিছুই ভাবতে হবে। দলের টাকা কিভাব কোথা থেকে আসবে কিভাবে, কি জন্য একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে খরচ হবে সেটাও পরিস্কার থাকা দরকার।
সংস্কার বা পরিবর্তন খুবই কঠিন কাজ। যে কোনো কিছু বদলে ফেলাই কঠিন। নিজেকে বদলে ফেলা আরও কষ্টসাধ্য। সবচেয়ে বড় কারণ নিজের ভুলগুলো চোখে পড়ে না, পড়লেও মেনে নেয়া যায় না। কেউ বললে বরং তার উপর রাগ হয়। কেউ কিছু শুনতে চায় না, মানতে চায় না। আর রাজনীতি বা দল হলে তো আরও।
সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন বা সংস্কার না হলে বিপর্যয় আসতে পারে। যেটা এবার হয়েছে বা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর ক্ষতের তৈরি হয়েছে। ব্যাপক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, যা ভাবনা থেকে উদ্বেগের পর্যায়ে চলে গেছে। উদ্বেগ থেকে উৎকণ্ঠা, সেখান থেকে বিপর্যয়।
রাজনৈতিক সংস্কার আদৌ কি সম্ভব। কিভাবে সম্ভব। তারপরও এটা নিয়ে কথা উঠছে। অনেক ধরনের ভাবনা, প্রস্তাব, প্রস্তাবনাও আসছে কিন্তু কোনোটাই কাজে আসছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা কোনো বিষয়েই একমত হওয়া যাচ্ছে না। সামান্য একটা বিষয়েও যেখানে একমত হওয়া যায় না। সেখানে এত বড় বিষয়ে একমত হওয়া অত্যন্ত কঠিন।
রাজনৈতিক দলের শুদ্ধি আনতে চাইলে প্রথমেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সততা দরকার। দলের খরচের টাকা দলকে সৎ উপার্জনের মাধ্যমে জোগার করতে হবে। আর যারা সক্রিয় রাজনীতি করছেন বা শুধুই রাজনীতি করছেন বা করবেন তাদের খরচ দলকে দিতে হবে। বিষয়টা খুবই অসম্ভব মনে হচ্ছে। এটা না হলে রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব না। দুর্নীতির শুরু টাকার সহজ প্রাপ্তি থেকে।
রাজনীতিবিদদের যদি বৈধ আয়ের পথ না থাকে তবে তো তারা অবৈধ পথই খুজবেন। বৈধ উপার্জনের উপায় থাকতেই হবে। রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেবার একটা পথ থাকা দরকার। না হলে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হবে না।
দলের নেতারা যাতে স্বচ্ছন্দে কাজ করে যেতে পারেন সে রকম একটা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। একজন নেতা বা কর্মীকে যদি সারাক্ষণ সংসার কিভাবে চলবে সে চিন্তায় থাকতে হয় তবে দল বা জনগণের জন্য কাজ করা দুরুহ।
দলের উপার্জন কি দলই করবে নাকি আরো কোনো পন্থা আছে। দল যদি ব্যবস্থা করতে পারে তবে খুবই ভালো না হলে বিকল্প উপায় ভাবতে হবে। বিকল্প মানে এমন ব্যবস্থা যা দলক স্বাবলম্বি করে তুলবে।
রাজনীতি যখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে তখন থেকেই বিপর্যয় শুরু। আর যখন থেকে ব্যবসায়ীরা রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছেন তখন সেটাকে তারা বিনিয়োগের প্লাটফর্ম বানিয়ে ফেলেছেন। এতে কিছু মানুষের অনেক বেশি লাভ হলেও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজনীতি।
যখনই বিনিয়োগের প্রশ্ন এসেছে তখন সেই বিনিয়োগ তুলে নেবার তাগিদ এবং আরও বেশি লাভ করার লোভ তৈরি হয়েছে। পুরোনো প্রবাদ অতি লোভে তাতি নষ্ট। আর সেই নষ্টের ফল এতটাই ভয়ংকর যে অনেক মানুষের জীবন দিয়েও সেটা শোধ হচ্ছে না, সমগ্র জাতি ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। তাহলে উপায়। পথ তো একটা বের করতেই হবে। না হলে প্রলয়ের হাত থেকে তো কেউ বাঁচবে না।
রাজনীতিবিদিদের জন্য কৌলুষ এবং চিন্তামুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। নিজেদেরকেই নিজের খোড়া কুয়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আর সবার পতন ঠেকাতে হবে, যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা রাজনীতি করতে এসেছেন।
এমন একটা বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে যাতে কাউকে দুর্নীতি করতে না হয়। দেখতে হবে একজন মানুষের সংসার চালাতে মোটামুটি কত টাকা লাগে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। আর যারা রাজনীতি করতে আসেন তাদের একটা বড় উদ্দেশ্য থাকে মানুষের সেবা করা। সে কারণে কিছুটা সেক্রিফাইস তো করতেই হবে।
যিনি রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেবেন দলকে তার প্রয়োজন মেটাতে হবে তাকে নিরবচ্ছিন্ন কাজের পরিবেশ দেবার জন্য। এরপরও কেউ অন্যায় বা দুর্নীতি করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যথাযথ ব্যবস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, এই শব্দগুলো খুবই অস্পষ্ট, দুর্বল। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্র, আইন কানুন, নিয়ম নীতি ঠিক থাকলে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। আর ব্যবস্থা নিলেই অবস্থার পরিবর্তন হবে। নয়তো নয়।
রাজনৈতিক দলের জন্য যারা কাজ করবেন তাদের নিয়মিত খরচ দিতে হবে, তাদের প্রয়োজন অনুসারে। অনেকটা বেতন দেয়ার মত। বা বেতনই। সেটা কি সম্ভব, কিভাবে জোগাড় হবে টাকা, কে দেবে, কেন দেবে, এসব অনেক প্রশ্ন চলে আসে। আর খরচ হবে কিভাবে হিসাব দেবে কে। সেটাও বড় প্রশ্ন।
একটা দলের জন্য কত টাকা প্রয়োজন। এটাও একটা জটিল হিসাব। বড় দলগুলো বলবে দল যত বড় খরচ তত বেশি। আবার ছোট দল বলবে ওদের খরচও কম নয়। খরচ আছে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে সেটা একটা কাঠামো বা নিয়ম নীতির মধ্যে হয়। তাহলে বদলে যেতে পারে অনেক কিছু।
রাজনীতিবিদরা বলবেন দলের গঠনতন্ত্র, অবকাঠামো, খরচের প্রক্রিয়া আয়ের উৎস সবই ঠিকঠাক আছে। তাহলে সমস্যা কোথায়। সমস্যাও নিশ্চয়ই আছে। না হলে এত প্রশ্ন এত বিতর্ক, এত বিপর্যয় কেন তৈরি হবে। প্রচলিত আইন কানুন, নিয়ম নীতি যখন যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয় না, তখন অনিয়ম দুর্নীতি হয়। আবার সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলেও ঝামেলা তৈরি হতে পারে।
এতদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক টাকা খরচ করে আসছে। দিন যত যাচ্ছে খরচ তত বাড়ছে। খরচ যত বাড়ছে দলের দুর্নামও তত বাড়ছে, সেই সাথে দুর্গতি। সে কারণেই খরচের একটা নির্দিষ্ট কাঠামো থাকতে হবে। প্রতিদিন বা প্রতি মাসে কোথায় কয় টাকা কেন খরচ হচ্ছে সেটার সুনির্দিষ্ট হিসাব থাকতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আনতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে প্রয়োজন অপ্রয়োজনের মাত্রা ঠিক করবে কে। কেনই বা করবে। এ জন্য দলের নির্ধারিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন। তাকে হিসেব নিতেও হবে আরার দিতেও হবে। বলবেন সবই তো আছো সবাই আছে তাহলে ঝামেলা কোথায়। তাহলে বুঝতে হবে ব্যবস্থার মধ্যে ঝামেলা অথবা ব্যববস্থাপনায়। অথবা দল কিংবা ব্যক্তি।
সমস্যা ব্যবস্থা এবং ব্যবস্থাপনায়। আইন নিয়মও আছে কিন্তু সেটা কেউ মানছে না। অথবা ব্যবহার করছে ব্যক্তি স্বার্থে। সুতরাং সংস্কার প্রয়োজন। কিভাবে হবে সংস্কার এ বিষয়েও কেউ একমত হতে পারছে না। একমত হলে তো সব সমস্যাই মিটে যায়। কিন্তু সেটি হবে বলে তো মনে হয় না। তাই এমন কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে যাতে সমস্যার উদ্ভব না হয়।
একটা পথ হতে পারে পেশাগত ব্যবস্থপনা গড়ে তোলা। পেশাদার রাজনীতিবিদ। রাজনীতিই হবে যাদের পেশা। সনাতনী পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হবে। পেশাদারিত্ব। Professionalism. Work for money or money for work. এর বাইরে কিছু নেই। রাজনৈতিক দলে যে যে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবেন। তার সংসার চলার মত অবস্থা যাতে থাকে। যাতে সংসার আর টাকা কামানোর ধান্দায় যাতে সময় নষ্ট করতে না হয়।
প্রফেশনালিজম চালু হলে আরও সুবিধা আছে। রাজনীতিবদিরাও যে সাধারণ মানুষ। তারাও আর দশ জনের মত খেটে খান, পরিশ্রম করে টাকা কামান। তারা মহান কেউ নন। তারাও আর দশ জনের মতই সাধারণ। পার্থক্য শুধু তারা মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন। তার জন্য তারা আলাদা সম্মান এবং মানুষের সমর্থন পাবেন। সেই সাথে পাবেন মহামূল্যবান একটা ভোট।
রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের সাথে এমন আচরণ করেন যে তারা যা করছেন উদ্ধার করছেন, দয়া করছেন বা উদারতা দেখাচ্ছেন। দয়া, দাক্ষিণ্য, দায় নাকি উদারতা। কোনোটাই নয়, এটা হচ্ছে রাজনীতি। ভোটের লোভ, খ্যাতির হাতছানি আর ব্যক্তিগত স্বার্থ।
রাজনীতিবিদরাই তো সব সময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। সব দায় আর ঠেকা সাধারণ মানুষের। তাদের জন্য মিছিল করা, আন্দোলনের সময় মার খাওয়া, ভোটের সময় গায়ে খাটা থেকে শুরু করে সব দায় আম-জনতার। ওরা ভোট দিতে পেরে ধন্য হয় আর নেতারা ভোট পেয়ে হয়ে যান অন্য মানুষ।
রাজনীতি পেশা হিসেবে গড়ে উঠলে দায় বর্তাবে নেতাদের উপর। কারণ তারা মানুষের সেবা করার জন্য বেতন পাচ্ছেন, পরিশ্র্রমের জন্য পারিতোষিক। দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা তৈরি হবে। আমার টাকায় চলছো, সুতরাং আবার কথা তোমার ভাবতে হবে। আমার কথা শুনতে হবে। কাজ করতে হবে। আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হবার পর সরকার পারিতোষিক দেবে। সেটাও জনগণের টাকা।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন শুদ্ধ, সৎ পথে রাজনৈতিক দলের জন্য টাকা আসবে কিভাবে। প্রথমেই বলেছি খরচ কমিয়ে আনতে হবে। কেবল জরুরি খরচ। কিন্তু সেটাই বা জোগাড় হবে কিভাবে। অনেকগুলো দল, অনেক টাকার ব্যাপার।
দুটো সহজ রাস্তা আছে। একটা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন। আরেকটি হচ্ছে দলের নিজস্ব উপার্জন। চাঁদাবাজি বাদ দিয়ে নিজ পন্থায় উপার্জন। দলের জন্য চাঁদার ব্যবস্থা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে। এমনকি বড় দেশ, পুরোনো গণতন্ত্রের দেশগুলোতেও আছে। তাহলে সমস্যা কোথায়।
সমস্যা হলো অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা, অপব্যবহার, দুর্নীতি, চাঁদাবাজী, ধান্দাবাজি এসব। চাঁদা আর চাঁদাবাজি এক জিনিস নয়। চাঁদাবাজি হচ্ছে জোর করে নেয়া, মোটা অংকের টাকা দাবি করা, না দিলে হুমকি ধামকি, বিপদ। যা এখন চলছে এবং যে কারণে এই ব্যবস্থা বদলের কথা উঠছে।
Member subscription, সদস্য চাঁদা, একটা পুরোনো ভালো পদ্ধতিই ছিল। কিন্তু এখন আর ভালভাবে কাজ করছে না। খরচ এত বেড়ে গেছে যে এই টাকা দিয়ে চায়ের খরচও হয় না। কেউ চাঁদা দিতেও চায় না, বা দেয় না। আর এটা এতটাই সমান্য যে রাজনৈতিক দলগুলোও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আর সহজেই যদি অনেক টাকা পাওয়া যায়, তাহলে এসব নিয়ে সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।
বড় বিষয়গুলো ছোট হয়ে যাবার কারণেই বিপত্তি। সদস্য চাঁদার কার্যকারিতা আবার ফিরিয়ে আনা যদি সম্ভব হয় তাহলে ভালো। এটা পুরোনো ও অকাযর্কর হয়ে গেছে, ঢুকে গেছে নানা অসঙ্গতি। তবে ভালো দিকও আছে। তাই একে কার্যকর করে তোলা এবং বিকল্প খোঁজার চেষ্টা তো করাই দরকার।
জোর জবরদস্তি না করে খুব সামান্য টাকা যা দিতে সমস্যদের কোনো অসুবিধা হয় না তা যদি একটি দল নেয় তবে সেটা আয়ের একটা উৎস হতে পারে। সদস্যরা যখন বুঝতে পারবেন তাদের টাকা সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কাজে লাগছে তখন তারা চাঁদা দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন।
তবে এটা খুব ভরসার পথ নয়, এই আয় দিয়ে খুব সামান্যই রোজগার হবে। আয় বাড়ানোর আরো উপায় খুজতে হবে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব অফিস আছে, জায়গা আছে। সেগুলোর সৎব্যবহার করা যেতে পারে। সেখান মাল্টি স্টোরিড বিলডিং বানিয়ে ভাড়া দেয়া যেত পারে। সৎ আয় বাড়ানোর আরো অনেক পথের সন্ধানও করা যেতে পার। ইচ্ছে এবং চেষ্টা যদি থাকে তবেই সম্ভব।
আরেকটা আনুষ্ঠানিক রাস্তার প্রস্তাব বা ধারনা দেয়া যেতে পারে। সেটা খানিকটা অবাস্তব মনে হলেও কার্যকর হতে পারে যদি স্বদিচ্ছা থাকে। সেটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে নিবন্ধিত প্রত্যকেটা দলের জন্য বরাদ্দ থাকবে। দলের আকার, জনপ্রতিনিধিত্ব এবং প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে পারিতোষিক পাবে একেকটি দল। নির্বাচন কমিশনে এজন্য একটি আলাদা সেল বা পরি-দপ্তর গঠন করে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হবে। তারা পুরো বিষয়টি পরিচালনা করবে।
একেকটি দল তাদের কাঠামো অনুযায়ী ন্যূনতম খরচ কত হতে পারে নির্বাচন কমিশনকে সেই ধারনা দেবে। যার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। প্রথম শর্ত হতে হবে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন। নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত থাকবে। এখন যেমন বেশ কিছু শর্ত আছে।
সেই সাথে আরো কিছু শর্ত যোগ হবে বরাদ্দ পাবার উপযুক্ত হবার জন্য। যেমন কেন্দ্রীয় কমিটির আকার, জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন বা তৃণমূল পর্যায়রে অফিসের আকার খরচ এবং আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি। জন সমর্থন, প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা এবং নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের আনুপাতিক হার।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে নির্বাচন কমিশন টাকা পাবে কোথা থেকে। সরকারি বরাদ্দ থাকতে পারে। ভোটারদের চাঁদা বা দান দুটোই থাকতে পারে। ভোটার বা কোনো নাগরিক রাজনৈতিক দলকে চাঁদা না দিয়ে তার সামর্থ বা ইচ্ছে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে টাকা দেবে। নির্বাচন কমিশন দলের জনপ্রিয়তা, ভোটের অনুপাত, জনগণের জন্য দলের নেয়া কার্যক্রম এসব বিচার বিবচেনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে খুটিনাটি তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। প্রথমে নিবন্ধন পরে আয় ব্যয় এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় আসবে। আবার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত। কোনো দলের প্রতি বিরাগ বা অনুরাগের উপর ভর না করে নির্মোহ এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।
জনগণকে দয়া না করে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে এক একটি দল। আর জনমতের উপর নির্ভর করবে তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা। মানুষকে কাছে টানার চেষ্টা, সত্যিকার অর্থেই তাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য হবে প্রত্যকেটি দল। কারণ এর উপরই নির্ভর করবে দলের জন্য কমিশনের বরাদ্দ।
নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ এবং সদস্যদের নিয়মতি চাঁদার বাইরে রাজনৈতিক দলগুলো আর কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নিতে পারবে না। খরচের হিসেবও দিতে হবে নিয়মিত। নির্বাচনের সময় প্রচারণা এবং প্রার্থীদের জন্য বাড়তি বরাদ্দ থাকবে নির্বাচন কমিশনের। সবই হবে কঠিন নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের ভিতরে।
দলের ভেতরে এবং বাইরে তৈরি হবে প্রতিযোগিতা। দলের মধ্যে যারা সত্যিকার অর্থেই রাজনীতিবিদ তারাই টিকে থাকবেন। তৈরি হবে দলের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। অন্য দলের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্য টিকে থাকা নয়, টিকে থাকার ক্ষমতা।
একটা দলের টিকে থাকার জন্য কত টাকা প্রয়োজন। টিকে থাকার জন্য যতটা প্রয়োজন, যত টাকা দরকার, সবটাই কি এভাবে জোগাড় হবে। না হলে প্রয়োজনকে ছোট করে নিয়ে আসতে হবে। যে দল যত কম টাকা খরচ করে জনগণের কাছে বেশি প্রিয় হতে পারবে, নির্বাচন কমিশনের কাছে তার গুরুত্ব তত বেড়ে যাবে।
এই কঠিন প্রতিযোগিতার কারণে দলের সংখ্যাও কমে আসবে। যারা সত্যিকার অর্থেই রাজনীতি করতে চায় তারাই শুধু টিকে থাকবে। এতে নির্বাচন কমিশনের কাজটাও সহজ হয়ে আসবে। আর দলের পেশাদারিত্ব তৈরি হবে।
দল চালানোর সক্ষমতা, গণতন্ত্র এবং দলকে রাষ্ট্র পরিচালনার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। দলের জন্য যারা কাজ করবেন তারা পরবর্তীতে রাষ্ট্র চালানোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারবেন। যারা রাজনীতি করতে আসবেন তাদেরকেও আগে থেকেই সেই প্রস্তুতি নিতে হবে, নিজেকে পেশার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। পড়াশোনা এবং অন্যান্য প্রস্তুতিও নিতে হবে।
প্রকৃত মেধাবি, ত্যাগী নেতারা দলের নেতৃত্ব আসার সূযোগ পাবেন। দলের ভিতরে গণতন্ত্র চর্চ্চা ও সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। দলে সূযোগ্য নেতা আসবে যারা দল ও মানুষের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করবেন।
প্রচার প্রচারণা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আধুনিকতা, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার এবং নতুন ধরনের প্রক্রিয়া নিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং মিডিয়াকে ব্যবহার করে খরচ কমিয়ে মানুষের কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি করতে হবে। কম খরচে জনগণের সাথে কার্যকর যোগাযোগ তৈরি হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের দুর্নীতি ও কৌলুষমুক্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে চায় তবে কোনো একটা পথ বেছে নেয়া কঠিন নয়। কঠিন হচ্ছে বাস্তবায়ন। কারণ সেজন্য অনেকখানি স্বার্থত্যাগ করতে হবে, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলগুলো রাজনীতি করতে আসে।
দলগুলো প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। এসব কমসূচির বেশিরভাগই দলের এবং ব্যক্তির প্রচারণার উদ্দেশ্যে। আর এসবের অযুহাতে টাকা আদায় করা হয় বিভিন্ন কৌশলে। সামান্য সদস্য চাঁদা ছাড়া আর কোনো টাকা যদি দলগুলো কারু কাছ থেকে না নেয় তাহলে সমস্যা অনেকখানি মিটে যায়।
প্রচলিত রীতি যেখানে কাজ করছে না, সেখানে এই রকম জটিল হাইপোথেটিকাল, কল্পনাশ্রয়ী বিষয় কি কাজ করবে? আবারো বলছি স্বদিচ্ছা এবং চেষ্টা থাকলে সম্ভব। প্রচলিত ব্যবস্থা কি দোষ করলো। আসলে ব্যবস্থায় দোষ নেই, আছে আচরণে. মানসিকতায়। সব ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে বলেই তো এসব প্রস্তাবনা। এসব কাজ করবে যদি রাজনৈতিক দলগুলো চায়, রাষ্ট্রব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন এবং জনতা যদি চায়।
সবাই জনতা বা জনগণের কথা বলে। তবে কারা এই জনগণ, তারা কি চায় সেটা কেউ ভাবে না। ভাবলে এই অবস্থা হতো না। সবাই জনগণের কাধে ভর করে বন্দুক ফোটায়, কিন্তু কারা এই জনতা তাদের কেউ চেনে না। চেনার প্রয়োজনও বোধ করে না। সবাই বলে জনগণই সব, এই বলে জনগণক উপেক্ষা করেই সব কিছু করে। তবে সংস্কার যদি সত্যিই জনগণের জন্য হয় তবে অবশ্যই সেটা মানুষের কাজে লাগবে।
লেখক: লেখক, গবেষক, সাংবাদিক।