এপ্রিল ২৪, ২০২৫, ০৩:৫৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এলাকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় অঞ্চলটির সাম্প্রতিক শান্ত পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে।
এই পর্যটন এলাকাটি মুহূর্তেই রক্তাক্ত বিভীষিকার স্থলে পরিণত হয়েছে। এতে করে পরমাণু অস্ত্রধারী প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হামলার সময় বন্দুকধারীরা ঘন পাইন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
হামলার শিকার হওয়া লোকজন তখন পিকনিকের মেজাজে ছিলেন। কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছিলেন।
হামলার পরপরই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, এর ‘কড়া ও স্পষ্ট জবাব’ দেওয়া হবে।
‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামের স্বল্প পরিচিত একটি গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে।
তবে ভারত মনে করছে, এই গোষ্ঠী আসলে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা বা এমনই অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের ছদ্মনাম।
পাকিস্তান অবশ্য জঙ্গিদের কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা বলছে, কাশ্মীরিদের ‘স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে’ তারা নৈতিকভাবে সমর্থন করে।
এই নির্বিচার হত্যার ঘটনায় আবারও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। দুই দেশই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখণ্ড কাশ্মীর নিয়ে তিনটি যুদ্ধ করেছে।
এর বাইরে বেশ কয়েকবার তারা যুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থানে গিয়েছে।
নাম প্রকাশ করতে চাননি—ভারতের এমন একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেছেন, হামলাটি এমন এক সময় হলো যখন মাত্র এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার’ (‘‘জাগুলার” মানে গলার শিরা বা জাগুলার ভেইন। এটি শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্তনালিগুলোর একটি। কথ্য ভাষায় বা রাজনৈতিক ভাষণে ‘জাগুলার’ বলতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, জীবন-মরণের প্রশ্ন বা সবচেয়ে দুর্বল ও সংবেদনশীল জায়গাকে বোঝায়) বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের কাশ্মীরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে একা ফেলে দেব না।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এটি অঞ্চলটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। আমরা দেখছি, দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী এখন একে অপরের দিকে আক্রমণাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। এখন কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।’
হামলার পর ভারত প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানের হাই কমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমানবাহিনীর উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেছে; গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বাণিজ্য পথ বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং প্রথমবারের মতো সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে।
সিন্ধু পানিচুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বের অন্যতম বড় নদীব্যবস্থার পানিবণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই নদ ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনধারণে এর প্রভাব রয়েছে।
এত দিন কখনোই ভারত এই চুক্তিকে ‘স্থগিত’ করেনি; এমনকি দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ চলার সময়ও নয়।
তবে এই হামলার মধ্য দিয়ে যদি হামলাকারীরা কাশ্মীরিদের সমর্থন পাওয়া বা বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব আবার জাগিয়ে তোলার লক্ষ্য স্থির করে থাকে, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবে হিসাবে ভুল করেছে।
নিহতদের প্রতি শোক জানাতে হামলার পর কাশ্মীরের এক ডজনের বেশি সংগঠন তাদের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে।
সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ মিছিল করেছে এবং ‘পর্যটকরাই আমাদের জীবন’ বলে স্লোগান দিয়েছে।
শিব নাডার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ‘কাশ্মীরিরা সত্যিই এই ঘটনায় খুব ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত।’
কাশ্মীরে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। হিন্দুপ্রধান ভারত ও মুসলিমপ্রধান পাকিস্তান—দু’দেশই এই অঞ্চলকে নিজেদের দাবি করে আসছে। ১৯৮৯ সালে ভারতের বিরুদ্ধে এখানে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংসতা অনেকটাই কমেছে।
২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে দেয় এবং রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে ফেলে।
হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী মোদী সরকার বাইরের লোকদের কাশ্মীরে জমি কেনার অনুমতিও দেয়, যাতে কাশ্মীরকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত করা যায়।
এই পদক্ষেপের ফলে নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোর হয় এবং জঙ্গি তৎপরতা কমে যায়। ফলে পর্যটক সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০২৪ সালে রেকর্ড ৩৫ লাখ মানুষ কাশ্মীর ভ্রমণ করেন।
মোদী সরকার এই পরিস্থিতিকে ‘সাধারণীকরণ’ হিসেবে তুলে ধরে রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে প্রচার করে।
তাদের মতে, শক্ত অবস্থান গ্রহণের ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ বন্ধ হয়েছে এবং এই বরফে ঢাকা সবুজ উপত্যকা এখন ‘ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত’। তবে স্থানীয় অনেকেই অতিরিক্ত সেনা উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আরেকজন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, সরকার যে বলে এসেছে, ‘সব স্বাভাবিক’, এই হামলা সেই বক্তব্যের সত্যতাকে খণ্ডন করেছে।
মোদী সৌদি আরবে সরকারি সফরে থাকলেও দ্রুত দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিনে, সরকার এ ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে চায়।
দিনদুপুরে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা একটি এলাকায় এমন হামলার পর সরকারকে কড়া প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর যেমন ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাল্টা হামলা করেছিল, এবারও তেমন কিছু করতে পারে।
পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু এবার যেহেতু নিহত ব্যক্তিরা সাধারণ পর্যটক, তাই রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।
একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘ভারত বসে থাকতে পারে না। একবার যদি উত্তেজনার পালা শুরু হয়, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আপনি মোদিকে বুঝতে পারবেন না। তিনি কী করবেন তা বলা কঠিন। তিনি খুবই আগ্রাসী মানসিকতার লোক।’
এই হামলার সময়টা রাজনৈতিকভাবে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়টাতেই যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতে সফর করছিলেন।
ভ্যান্স তার প্রথম সরকারি সফরে ভারতে এসে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার কথা বলেন এবং ভারতকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে প্রশংসা করেন।
২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের পার্লামেন্টে এক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
ভারত অভিযোগ করেছিল, হামলাটি পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীরা করেছে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা কমাতে কূটনৈতিকভাবে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
এ প্রসঙ্গে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আমরা যেসব বার্তা পাচ্ছি, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি ভারতের পাশে রয়েছে এবং ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করবে না।’
লেখক: পেনেলোপ ম্যাকরে, দিল্লিতে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে লেখালেখি করেন।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ।
(লেখাটি গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে প্রথম আলো।)