৭১’র মুক্তিযোদ্ধা কারা? ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতেই-বা কী বোঝানো হয়?
এ-নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষত ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন মহল থেকে জোরেসোরে বলা হচ্ছে যে, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ নিজের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে পরিণত করেছে আওয়ামী লীগের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পেয়েছে দলীয় ও নিজেদের পছন্দের লোকদের নাম।
তাই মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর, সেই পুরনো অমীমাংসীত বিষয়গুলো আবারো প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছে। প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা’ বদল করার, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল ও বিতর্কমুক্ত তালিকা তৈরি করার।
জামুকা পুনর্গঠন
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব নিয়ে কাজ করার জন্য রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণসহ তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধনের কাজটি করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকা।
ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজমকে চেয়ারম্যান করে জামুকা পুনর্গঠন করা হয়েছে। দুটি বৈঠকও করেছে তারা। বৈঠকে জামুকা আইন সংশোধন, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণ, মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ঠিক করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দের ব্যবহার যৌক্তিক কি না—এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্যমান তালিকাও যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তালিকা থেকে ‘অমুক্তিযোদ্ধাদের’ নাম স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে।
নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী কারা হবেন মুক্তিযোদ্ধা?
প্রস্তাবিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারীরাই হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে যারা বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী, শিল্পীসমাজসহ যারা মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তারা হবেন ‘যুদ্ধ সহায়ক’।
একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সেও পরিবর্তন আসতে পারে।
বিদ্যমান সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কারা?
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড এখন পর্যন্ত ১১ বার বদলানো হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার।
১৯৭২ সালে প্রথম মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। সেই সংজ্ঞায় ‘মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন’ তাদেরই মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়েছে।
২০১৬ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। সেই অনুযায়ী ২০১৮ সালে ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন’ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়।
২০২২ সালে, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল (জামুকা) আইনেও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়। সংজ্ঞায় বলা হয়, “যারা ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে’ দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এবং যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।”’
সংজ্ঞায় রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের পাশাপাশি বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী বাংলাদেশি নাগরিক, মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকারের অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী-দূত, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ, যারা পরে গণপরিষদ সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন।
এ ছাড়া দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিতা সব নারী -বীরাঙ্গনা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলা-কুশলী, দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় এবং মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া মেডিক্যাল টিমের ডাক্তার, নার্স ও সহকারীদেরও মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সংজ্ঞার সঙ্গে পার্থক্য
প্রস্তাবিত খসড়ার সংজ্ঞায় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচিত হবেন কেবল তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এবং বীরাঙ্গনারা। পূর্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী যারা মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হলেও নতুন প্রস্তাবিত সংজ্ঞায় তাদের শ্রেণিভুক্ত করা হচ্ছে ‘যুদ্ধ-সহায়ক’ নাম দিয়ে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো, মুক্তিযোদ্ধার বর্তমান সংজ্ঞায় থাকা ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে’ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অংশটুকু বাদ যেতে পারে।
বয়সের ক্ষেত্রে পরিবর্তন
বয়সের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স ১২ বছর ছয় মাস। বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ছয় মাস ছিল তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন। নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স ১৩ করা হতে পারে। এছাড়া বয়সের ভিত্তি হবে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বরের বদলে ২৬ মার্চ।
তবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নির্যাতিতা নারী বা বীরাঙ্গনার ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বয়সসীমা প্রযোজ্য হবে না।
এ নিয়ে কালের কণ্ঠে ‘বদলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্নার মন্তব্য নেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি আইনটা দেখে পরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাই, এখনই নয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, রাজাকারসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র ছিল না। তা না হলে সাড়ে চার কোটি মানুষই হাতে অস্ত্র তুলে নিত। যুদ্ধ সহায়করাও মুক্তিযোদ্ধা।’
বাদ দেয়া হচ্ছে ‘অমুক্তিযোদ্ধাদের’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে ‘অমুক্তিযোদ্ধাদের’ বাদ দেয়ার কাজও শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত ১৭ নভেম্বর ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’ দেয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা ফারুক ই আজম ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, যদি কোনো ব্যক্তি (অমুক্তিযোদ্ধা) স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে চলে যেতে চান, তাহলে তাঁকে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) দেওয়া হবে। সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। নাম প্রত্যাহার না করলে প্রতারণার দায়ে তাদের অভিযুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৬ সালে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। এটি জাতীয় তালিকা নামে পরিচিত। এরপর ১৯৮৮ সালে ৬৯ হাজার ৮৩৩ জনের আরেকটি তালিকা প্রকাশ করা হয়, যা ভারতীয় তালিকা হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তৃতীয়বার ৮৬ হাজার জনের তালিকা, ১৯৯৬–০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চতুর্থবারের মতো ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (সবুজ) হিসেবে পরিচিত। পরে আরও যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের আরেকটি তালিকা করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (লাল) হিসেবে পরিচিত।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০১–০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে একটি কমিটি করে। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা (অপূর্ণাঙ্গ) প্রকাশ করা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিয়েও পূর্ণাঙ্গ তালিকা আর প্রকাশ করেনি। বিগত সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ তালিকায় সংখ্যাটি ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি হবে না।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের তালিকা ও সংজ্ঞা বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত হয়েছে। তালিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসও আছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও সংজ্ঞা পরিবর্তনের রাজনীতি দেশে চলতে থাকবে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা এসব পরিবর্তন করবে। পরিবর্তনের এই প্রবাহ কোনোকালে শেষ হবে না।
আফসান চৌধুরী বলেন, যে সরকারই আসুক, তারা নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা করবে। কারণ, তালিকায় নাম দেওয়া মানে হচ্ছে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের দুটি পরিসর আছে। একটি রাষ্ট্রীয়, অন্যটি সামাজিক। রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে। সমাজে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাসের বয়ান রয়েছে, সেটা পাল্টায়নি। সেটা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষমতার সঙ্গে নয়।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে কী বোঝায়?
প্রস্তাবিত খসড়ায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-কেও সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত বাংলাদেশের জনগণের সমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের যে চেতনা তাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।”
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন।