‘আমার গরুর মাংস খুব পছন্দ। মাসের শুরুতে ১০-১২ কেজি করে গরুর মাংস কিনি একসঙ্গে। অনেকসময় ১০ কেজি ১০ দিনেও শেষ হয়ে যায়।’
রাজধানীর কাওরান বাজারে বাজার করতে এসে এমনটাই বলছিলেন একজন ক্রেতা। গরুর মাংসের দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেও প্রভাব পড়েনি এই ক্রেতার ওপর।
তবে মুদ্রার উল্টো দিকের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সেখানে দেশের বাজারে গরুর মাংসের দামে যে আগুন, তার ধোঁয়ায় ধরাশায়ী সাধারণ মানুষ৷
একইসময়ে কাওরান বাজারে বাজার করতে আসা শিরিন আহমেদ বলেন, ‘আগে শুক্রবার পরিবারের সবাই মিলে একটু ভালো-মন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম। বাচ্চাদের গরুর মাংস পছন্দ তবে মাসে বড়জোড় একবার গরুর মাংস কিনতে পারি। তাও অনেক হিসেব-নিকেশ করে।’
গরুর মাংস এখন এমন খাদ্যে তৈরি হয়েছে যে উচ্চবিত্তদের কাছে অতিরিক্ত এই দামে ১০ -১২ কেজি কেনা কোনো সমস্যা না হলেও, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তদের আক্ষেপ, গরুর মাংস খেতে হলে মাসের খরচ নিয়ে খাতা কলম ক্যালকুলেটরে হিসাবে মিলিয়ে নিতে হয় কয়েক সপ্তাহ বা কয়েকমাস ধরে। একশ্রেণির মানুষের ওপর এই দাম প্রভাব ফেলতে না পারলেও, গরুর মাংসের দাম যে অতিরিক্ত বেশি তা মানেন সব শ্রেণির মানুষই ।
গেল কয়েক বছর ধরে গরুর মাংসের দাম অত্যাধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বাজারে কেজি প্রতি গরুর মাংসের দাম প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা । যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে গরুর মাংসের কেজি ২০০ থেকে ২৫০ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৬০ থেকে ৩০০ টাকা। পাকিস্তানে এক কেজি গরুর মাংসের দাম প্রায় ৮২৫ রুপি , যা বাংলাদেশে ৪০০ টাকার সমান।
২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে গরুর মাংসের দাম ছিল ৩৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। যেখানে বাংলাদেশের ছিল ৬৮৪ টাকা । ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে এসেও দফায় দফায় গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ভারত বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে ঢাকার বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ২৩০-২৫০ টাকা। নিষেধাজ্ঞার আগে চোরাচালান করা ভারতীয় গরু বাংলাদেশের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করত। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে গরু আনার বিষয়টিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। যদিও বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত দিয়ে গরু আনা আগেও অবৈধ ছিল। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় দেশের বাজারে দেশীয় গরুর আধিপত্য বেড়ে যায়। খামারি বা উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ে ব্যাপকভাবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০১৯ -২০ অর্থ বছরে মাংস উৎপাদন হয়েছে ৭৬ লাখ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংস উৎপাদন হয়েছে ৮৪লাখ মেট্রিক্টন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৯২ লাখ টন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া—সব মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম। যে দেশে খামার নিয়ে এত ভালো ভালো খবর, মাংস উৎপাদনে যে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে দেশের গরুর মাংসের কেজি কেন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা?
এমন প্রশ্নের উত্তরে কাওরানবাজারের খুচরা মাংস বিক্রেতা হাসান সিকদার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘আমরা যে দামে কিনি তার চেয়ে কিছু বাড়িয়ে বিক্রি করি। আমাদের কোনো লাভ নেই। বরংচ দাম বাড়ায় ক্রেতা কমছে তার প্রভাব পরছে আমাদের ওপর।’
কারণ হিসেবে আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘সারাবছর খামারিরা তেমন গরু ছাড়ে না। কোরবানির জন্য আটকে রাখে। কারণ কোরবানিতে গরুর দাম প্রায় ২০-৩০ হাজার টাকা বেশি থাকে। যদি খামারিরা সারাবছর সমানভাবে গরু ছাড়তো তাহলে গরুর মাংসের দাম এতো বেশি থাকতো না।’
তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ খামারিরা।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাদেক এগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, তারা কখনই কোরবানির জন্য গরু আটকে রাখেন না। সারাবছর যেমন চাহিদা থাকে তেমনই গরু বিক্রি করেন তারা।
তিনি মাংসের দাম কমানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘চামড়ার যে ব্যবসা তা এখন তলানীতে বলা চলে। আমাদের উচিত চামড়া ব্যবসায় জোর দেয়া, চামড়ার দাম বাড়লে গরুর মাংসের দাম অনেকটা কমবে। এছাড়া সঠিক উপায়ে গরু জবাই বা প্রক্রিয়াজাত করা গেলে গরুর রক্ত বিক্রি করেও আয় করা যাবে। গরুর রক্ত মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এসব বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিলে গরুর মাংসের দাম কমানো সম্ভব।’
এদিকে, নিজেরা উৎপাদন করে দাম যখন সীমার মধ্যে থাকার কথা, তখন উল্টো দিন দিন অসীমে পৌঁছে যাচ্ছে গরুর মাংসের দাম। এর আগে সিটি করপোরেশন একাধিকবার গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি তদারকির অভাবে।
গত রমজানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর মাত্র ৬৪০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি করে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, উৎপাদন খরচের সাথে বাজার মূল্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু সিন্ডিকেটের কারণে, ঠিকভাবে বাজার মনিটর করা গেলে গরুর মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।