জুন ৬, ২০২২, ১১:৩৭ পিএম
‘আমার ফরমানুলকে কেউ চিনতে পারছিলো না। সবাই তাকে সামনে রেখেও নাম ধরে ডাকছিল আর এদিক সেদিক খুঁজছিল। সেই সময় ফরমানুল নিজেই বলে আমি ফরমানুল।’ -এমন বিলাপ করছিলো ফরমানুলের স্বজনরা।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে লাগা আগুন ও বিস্ফোরণে গুরুতর দগ্ধ ফরমানুলেল শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ডান চোখে দেখতে পাচ্ছে না। নেয়া হয়েছে আইসিইউতে। আইসিইউ এর সামনে প্রহর গুনছে ফরমানুলের চাচ-চাচী, মামা, খালুসহ আরও অনেকেই। শুধু ফরমানুলেরই না এমন আরো দগ্ধদের ভেতরে এবং বাইরে স্বজনদের আহাজারিতে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
শনিবার রাতে আগুন লাগলে গতকাল রবিবার চট্টগ্রাম থেকে গুরুতর দগ্ধদের রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়। শুরুতে ১৪ জনের মধ্যে আইসিইউতে একজন রোগী থাকলেও আজ সেই রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ জনে। এদিকে বার্ন ইউনিটে মোট ১৬ জন রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।
গুরুতর দগ্ধ ফরমানুল ইসলাম গতকাল রবিবার বেডে থাকলেও সোমবার তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান স্বজনরা। তিন বোনের এক ভাই হচ্ছেন ৩০ বছর বয়সী এই ফরমানুল।
ফরমানুলের চাচী ফরিদা ইয়াসমিন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “গত নয় বছর ধরে কনটেইনার ডিপোতে রিসিভার কনটেইনার হিসেবে কাজ করছেন ফরমানুল। ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে ফরমানুল তার চাচাকে ডিপোতে আগুন লাগার কথা ফোন করে জানায়। ফায়ার সার্ভিসের লোক আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে বলেও জানায় সে। আর বলে ঘটনাস্থল থেকে সে দূরে আছে। এই ঘটনায় একই ডিপোতে কাজ করা ফরমানুলের বন্ধু তাকে খুঁজতে ঘটনাস্থলে যায়। পরে তাকে চিন্তে না পারায় হাসপাতাল নিতে দেরি হয়। প্রথমে চট্টগ্রাম হাসপাতালে নেয়া হলেও অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছে আরেক দগ্ধ রোগী মানিকগঞ্জ শাটুরিয়ার বাসিন্দা রবিন। দেড় বছর হলো ফায়ার ফাইটার হিসেবে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে। রাতে ঘটনাস্থলে দূর্ঘটনার শিকার হলেও সকালে পরিবারের লোকজনের কাছে খবর আসে আদরের ছেলের বিষয়ে।
রবিনের বাবা কান্না জড়িত কণ্ঠে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, আমি রবিবার সকালে খবর পেয়ে ঢাকায় এসেছি। সায়দাবাদ যাওয়ার পর জানতে পারি আমার ছেলেকে ঢাকায় আনা হচ্ছে হেলিকপ্টরে করে। শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে রবিনের। আইসিইউতে রয়েছে। কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রবিনের বৃদ্ধ বাবা।
ওই ঘটনায় দগ্ধ আরেকজন শারমিন গ্রুপের কাভারভ্যান চালক নজরুল ইসলাম মণ্ডল বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তার ভাই বলেন, কনটেইনারে আগুনের খবর শুনে গাড়ি থেকে নেমে দেখতে গিয়েছিলেন নজরুল। এ সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ হলে আগুনযুক্ত কেমিক্যাল এসে পড়ে তার গায়ে। অন্যদের সঙ্গে তাকেও উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ছেলের সহকর্মীদের বরাতে গুরুতর দগ্ধ ফায়ার সার্ভিসকর্মী গাউসুল আজমের বাবা আজগর আলী বলেন, এমন ভয়াবহ ঘটনা তারা আগে কখনও দেখেননি। বিস্ফোরণের সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ যায়। তরল কেমিক্যালের কারণে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও আগুনে ৬৩ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয় জনের চোখের সমস্যা গুরুতর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্ন ইনস্টিটিউটের এক সূত্র জানিয়েছে, তাদের এখানে চিকিৎসাধীন রোগীদের প্রায় সবার চোখে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। লাল হয়ে আছে চোখ, আলোতে তাকাতে পারছেন না তারা। এর পেছনেও কেমিক্যালের প্রভাব রয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিটউটে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে অবস্থান করা বিএম কনটেইনার ডিপোর স্মার্ট গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) মমতাজ উদ্দিন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আমরা রোগীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য এখানে সার্বক্ষণিক রয়েছি। তবে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রতিষ্ঠান দায়ী নয় বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ ৪১ জন নিহত হয়েছে। আগে নিহতের সংখ্যা ৪৯ বললেও চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসন সোমবার জানিয়ে দেয়-আগের তথ্য ভুল ছিল, সীতাকুণ্ডে আগুন ও বিস্ফোরণে মৃত্যুর সসংখখ্যা ৪১। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন প্রায় দুইশতাধিক।
সোমবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের দেখতে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং আহতদের চিকিৎসায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের সব হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দগ্ধদের মধ্যে যাদের ঢাকায় আনা হয়েছে তাদের জন্য আলাদা মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। চট্টগ্রামেও একটি আলাদা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তারা মাঠ পর্যায়ের কাজ করছে। এসবের পাশাপাশি সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এর আগে, দুপুর দেড় টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের দেখতে আসেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ । তিনি বলেন, যারা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে তাদের সবাইকে পুনর্বাসন করা হবে। তবে এই মূহুর্তে রোগীদের সুস্থতার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, দুর্ঘটনার ৭২ ঘন্টা (এ প্রতিবেদন লেখার সময়) পার হলেও এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি আগুন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনও বেশ কয়েকটি কনটেইনার দাউ দাউ করে জ্বলছে। চারটি বড় কন্টেইনারে যেকোন মুহূর্তেই হতে পারে বিস্ফোরণ।
অপরদিকে, এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের তিনকর্মী। সোমবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) মো. শাহজাহান সর্দার দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান,
“শনিবার রাত ১১টা ২৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। এসময়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ফায়ার ফাইটাররাও হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন আরও তিনজন।”
নিখোঁজ ফায়ার ফাইটাররা হলেন মো. রবিউল ইসলাম (ফায়ার ফাইটার), ফরিদুরজ্জামান (ফায়ার ফাইটার) ও শফিউল ইসলাম (ফায়ার ফাইটার)।