মে ১১, ২০২৩, ০১:২০ এএম
বৈশাখী উত্তাপ পোড়াচ্ছে নগর থেকে গ্রাম—সর্বত্র। এমনই এক ভোরবেলায় প্রতিদিনের মতো রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের পাশে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন স্থানীয় লোকজন। কিন্তু তাদের পথচলা থেমে যায় যখন তাঁরা দেখেন সরোবরের পদ্মফুল আর পদ্মপাতার ফাঁক গলে কোনো এক অজ্ঞাত লোকের নিথর হাত বেরিয়ে এসেছে! তখনই খবর দেওয়া পুলিশে। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় তুলে আনা হয় তাঁকে। ফুলেফেঁপে উঠা লাশ! জানা গেল, ওই ব্যক্তি আর কেউ নন, আগের দিনই নিখোঁজ হওয়া ফার্মাসিস্ট এ বি ইমতিয়াজ আহমেদ খিলজিই (৫৮) তিনি।
ইমতিয়াজের পরিবার, স্বজন ও পুলিশ সূত্র জানায়, ইমতিয়াজ আহমেদের বাড়ি মিরপুরের মনিপুরে। ধানমন্ডি তিন নম্বর রোডে নিজের ফ্ল্যাটে স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা বেবি ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। তিনি জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালের নির্বাহী পরিচালকও ছিলেন।
তদন্তসূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালসে কর্মরত অবস্থায় ইমতিয়াজ আহমেদের আগে বেতন ছিল প্রায় ৮ লাখ টাকা। তবে ৩ মাস আগে চুক্তিভিত্তিক হিসেবে কাজ শুরুর পর তা ৪ লাখে নেমে আসে। এতে তাঁর নিয়মিত জীবনযাপনের হিসাবনিকাশে ছন্দপতন ঘটে। আবার চলতি মাসে তাঁর বর্তমান চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর নতুন করে নিয়োগ পাবেন কি-না, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অর্ধেক বেতনে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছিলেন ইমতিয়াজ। সেই চুক্তির মেয়াদও ছিল শেষের পথে। এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। আবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে ছিল পারিবারিক অশান্তি। এসব কারণে মানসিক বিপর্যয় থেকে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।
এরইমধ্যে ধানমন্ডির বাসা থেকে গত রবিবার সকালে হাঁটতে বের হন ইমতিয়াজ। পর তাঁর কোনো খোঁজ মিলছিল না। সারাদিন খোঁজ না পেয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলে ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছিলেন স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা। ঠিক তাঁর একদিন পরই গত ৮ই মে তাঁর লাশ ভেসে উঠে ধানমন্ডির ৪ নম্বরের পাশের লেকে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র গণমাধ্যমকে জানায়, ইমতিয়াজ প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যেতেন। সেখানে তাঁর সাথে এক নারীর পরিচয় হয়। দু'জনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলে ২০২১ সালে তাঁরা গোপনে বিয়ে করেন। এক সময় তা প্রকাশ পেলে তাঁর পারিবারিক জীবনে বড় ধরণের অশান্তি শুরু হয়। সব মিলিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি।
গতকাল দ্য রির্পোর্ট ডট লাইভের এই প্রতিবেদক ফার্মাসিস্ট ইমতিয়াজের ধানমন্ডির বাসার সামনে গিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। তিনি জানতে পারেন, ইমতিয়াজ আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম তাসলিমা সুলতানা বেবি। তাদের দুটি ছেলে সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে রাজিন থাকেন অস্ট্রলিয়ায়। আর ছোট ছেলে সামিন দেশেই থাকেন।
ইমতিয়াজের দ্বীতিয় স্ত্রীর নাম লিমা। তিনিও ধানমন্ডির (১২- এ ) তাকওয়া মসজিদের গলিতে ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁর আগের ঘরের তিন সন্তান নিয়ে ওই বাসায় থাকেন। আগের সংসারে স্বামীর সাথে ডির্ভোসের পর তিনি অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন। লিমার পরিবার ও ইমতিয়াজ-বেবি দম্পতি পরিবার র্পূব পরিচিত বলে জানান প্রতিবেশীরা। তবে তাঁদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে কিনা, কেউ বলতে পারেননি।
প্রতিবেশীরা আরও জানান, একসময় লিমা বেবিদের বাসায় অহরহ আসা যাওয়া করতেন। তবে কয়েক বছর ধরে লিমা বেবিদের বাসায় আর আসেননি। ইমতিয়াজ প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে গেলে সেখানে লিমার সাথে দেখা হতো। পরে তাঁরা বিয়ে করেন।
পাশের ফ্লাটের এক বাসিন্দা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আমরা এসব কলহের কথা শুনেছি। তাঁর বাড়িতে রোজার সময় যে কাজের বুয়া ছিল তাঁর মুখ থেকেও শুনেছি। কলহ শুরুর পর ইমতিয়াজ কয়েক মাস ধরে নিজের রান্না নিজেই করে খেতেন। এমনকি অফিস শেষে বাসায় এলে ভেতর থেকে দরোজা খোলা হতো অনেক দেরিতে।
ওই প্রতিবেশী আরও বলেন, শনিবার রাতেও অনেক ঝগড়া ও বাক বিতণ্ডার শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। রবিবার রাতে শুনলাম উনি বাসায় ফিরেননি। তাঁর স্ত্রী বের হয়ে পুরো ধানমন্ডি এরিয়া খুঁজেছেন। না পেয়ে থানায় জিডিও করেছেন। তারপরদিন দেখলাম বাসার নিচে পুলিশ। জানতে পারলাম, ইমতিয়াজ সাহেবের লাশ পাওয়া গেছে লেকে।
ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ৩০৬ ধারায় একটি (আত্নহত্যায় প্ররোচনা) মামলা দায়ের হয়েছে। প্রাথমিক যে সকল তথ্য উপাত্ত পেয়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে, নিহতের দুই পরিবার আছে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীও ধানমন্ডি এলাকায় থাকেন। এ কারণে পারিবারিক ঝামেলা চলছিল।
এ বিষয়ে ডিবিও ছায়াতদন্তে নেমেছে। ইমতিয়াজের দ্বীতিয় স্ত্রী লিমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবিতে নেওয়া হয়েছে। ইমতিয়াজ আহমেদের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁর হাতের কব্জিতে আগুনে পোড়া ও জ্বলসানো চিহ্ন রয়েছে। অন্য হাতের তালুর উল্টো পাশে রয়েছে মাংস ছিলা ও গোলাকৃতির চিহ্ন। তাঁর মুখ দিয়ে লালা জাতীয় আঠালো তরল বের হচ্ছিল। ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়া গেলে তাঁর মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে বলে মনে করছেন তদন্তদলের সংশ্লিষ্টরা।