ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩, ১১:৪৯ এএম
নানামুখী আলোচনা-জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পু। চলতি বছরই দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমাদের দেশে নির্বাচনী বছরটি অন্য বছরের চেয়ে উত্তেজণা-উৎকণ্ঠার হয়ে থাকে। বিরোধী দলগুলোর নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়। তখন সব পক্ষকে সমঝোতার টেবিলে আনতে অন্যান্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি বড় একটি ভূমিকা পালন করেন।
সে হিসেবে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরেই সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর ওপর বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে বিরোধী দলগুলোকে সাথে করে নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে অনুষ্ঠানের।
আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের প্রধান ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে ১২ ফেব্রুয়ারি দলের প্রার্থী হিসেবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নাম চূড়ান্ত করার পর রবিবার তাঁর মনোয়ননপত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন রবিবার পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে একমাত্র প্রার্থী হওয়ায় এ পদে আর ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে চুপ্পুই হচ্ছেন বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি।
জাতীয় সংসদে মোট ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের আড়াইশোর বেশি আসন রয়েছে। আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবে সংসদ সদস্যদের ভোটে। তাই নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতার বঙ্গভবনের বাসিন্দা হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ নতুন রাষ্ট্রপতির যোগ্যতা সম্পর্কে রবিবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, পদ্মা সেতুতে যে দুর্নীতি হয়নি, কানাডার আদালতে তা প্রমাণিত। কনাডার আদালতে কিন্তু বিশ্বব্যাংক গিয়েছিল এবং বিশ্বব্যাংক সেখানে হেরে গিয়েছে। কানাডার আদালত রায় দিয়েছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ গালগল্প ছাড়া কিছু না। কিন্তু, তারপরেও দুদক কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে তার ওপর অনেক চাপ ছিল। সেক্ষেত্রে তিনি দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন।’
তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “রাষ্ট্রপতি পদে প্রধানমন্ত্রী এমন একজনকে মনোনয়ন দিয়েছেন, যিনি ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছেন। তার মধ্যে ভদ্রতা, নম্রতা ও রাজনৈতিক বিজ্ঞতা আছে।”
রাষ্ট্রপতি পদে কে আসছেন তা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই বিএনপির। দলের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের দলের কোনো আগ্রহ নেই।
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ইউনিয়ন পর্যায়ে তাদের দলের দেশব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচিতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলা ও বাধার বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করা।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবেন তা নিয়ে তারা চিন্তিত নন, কারণ তাদের মূল ফোকাস এখন সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ তাদের ১০ দফা দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের দিকে।
রাষ্ট্রপতি পদটি একটি আলংকারিক পদ হলেও নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির পদ আর আলংকারিক থাকে না। এ সময় সংবিধানের সর্বোচ্চ পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। তাই নতুন রাষ্ট্রপতিকে এবারও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
১. জাতীয় সংসদ নির্বাচন
আসছে ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া এই নির্বাচনে যাবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে দেশের ‘প্রধান বিরোধী’ রাজনৈতিক দল বিএনপি। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বলছে, নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা সংবিধান অনুযায়ি চলবে। সংবিধানে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো উল্লেখ নেই। দুই দলের এই মতপার্থক্য কমাতে নতুন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব না হলেও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে শেষ ভরসা নতুন রাষ্ট্রপতির ওপরই বর্তায়। তাই নতুন রাষ্ট্রপতিকেই রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে আনতে ব্যর্থ হলে এক্ষেত্রে যার ওপর শেষ ভরসা করা যায় তিনি হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি।
২. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এবারের নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মত করা যাবে না। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, ওই দুই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, জাল ভোট ও আগেই ভোটবাক্স ভর্তি করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী করা হয়েছিল। এবার আর তারা সেই সুযোগ আওয়ামী লীগকে দিতে রাজি নয়।
ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এবারও সহিংসতার আশংকা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাই সব দলকে নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা মনে করছেন।
এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে রাজি করাতে দেশের অভিভাবক হিসেবে নতুন রাষ্ট্রপতির জোরালো ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দূর করার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির কিছুটা দায় থেকে যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৩. জাতীয় নির্বাচনের আন্তির্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা
আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু হোক—এটা বিরোধী দলের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন সহযোগি বিদেশি রাষ্ট্রগুলোরও চাওয়া। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোর সরকারও নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি চায়। নির্বাচনের সময় যেহেতু রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু থাকবেন, তাই এই চ্যালেঞ্জটিও তাঁকে মোকাবিলা করতে হবে।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভিভাবক। এ কারণে নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতির কাছে উন্নয়ন সহযোগি বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্র ও দাতাসংস্থা তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন, বিভিন্ন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানাতে চাইবেন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। এটি প্রমাণে ব্যর্থ হলে বর্হিবিশ্বের সাথে দেশের নানামুখী সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
৪. দলমত নির্বিশেষে সবার আস্থাভাজন হতে হবে
জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে বিরোধী দল ও সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এই সংকট বাড়বেই। মূলতঃ নিরপেক্ষ সরকার বনাম বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে পড়েছে। এ সংকট সমাধান করে দলমত নির্বিশেষে সবার আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জও মোকবিলা করতে হবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে। কারণ, তিনি সরকারের প্রধান নন, রাষ্ট্রের প্রধান।