সিগারেটসহ অন্যান্য তামকজাত পণ্যে কর আরোপ করার ফলে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমেনি। বরং সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের মাসিক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে একজন ধূমপায়ী শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের চেয়ে সিগারেট কেনায় ব্যয় করছে বেশি।
সিগারেটে ব্যয় হচ্ছে বেশি
সিগারেট ক্রয় করতে একজন ধূমপায়ীর গড় মাসিক ব্যয় হয় ১০৭৭.৭ টাকা। খানা আয় ওব্যয় জরিপ অনুসারে শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় যথাক্রমে মাত্র ৮৩৫.৭ এবং ৭০০ টাকা। অর্থাৎ গড়ে দুজন ধূমপায়ীর সিগারেটে মাসিক ব্যয় তিনজন ব্যক্তি মাসিক চিকিৎসা ব্যয়ের সমান। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী ২০০৯ সালের তুলনায় একজন বিড়ি ব্যবহারকারীর বিড়ি সিগারেট বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
সিগারেটসহ অন্যান্য তামকজাত পণ্যে কর আরোপ করার ফলে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমেনি। বরং সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের মাসিক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে একজন ধূমপায়ী শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের চেয়ে সিগারেট কেনায় ব্যয় করছে বেশি।
কথা হয় রায়হান হোসেনের সাথে। কারওয়ান বাজার মোড়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা রায়হান মুখোমুখি হয় দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভের। তিনি জানান, আয় ব্যয় বুঝি না। সিগেরেট না খেলে কাজে মন বসে না। প্রেসার মুক্ত জীবন চাইলে সিগারেট লাগবেই এমন মনে হয়। সিগেরেটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের তুলনায় অভ্যাসের কিছুটা পরিবর্তন এসেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নাহ আগের মতই আছে। দুই এক টাকা দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন কিছু আসে যায় না।
ভার্সিটি পড়ুয়া বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খাওয়া কম করা হয়নি। তবে আয় ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে সিগেরেটের ব্র্যান্ড চেঞ্জ করেছি। ঠিক একই কথা না বললেও কিছুটা কাছাকাছি বলেন রিকশা চালক শেখ নজিমুদ্দিন। তিনি বলেন, সিগেরেট খাওয়া ছাড়তে পারবোনা। আবার কমাতেও পারবোনা। তাই আনুষাঙ্গিক অন্যন্য ব্যয় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছি। সিগেরেট না খেলে কাজ করতে পারিনা।
তামাকে বছরে ক্ষতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা
তামাক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ২৬ হাজারের অধিক মানুষ মারা যায়। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ।
তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন আছে প্রয়োগ নেই
দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। পাবলিক প্লেস বা পরিবহনে তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে জরিমানা থাকলে তা শুধু আইনেই রয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন,২০০৫ অনুসারে,কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করিতে পারিবেন না। এজন্য তিনশত টাকা জরিমানা ও পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ দণ্ড দেয়া হবে। এছাড়া আঠারো বছরের নীচে কারও কাছে তামাকপণ্য বিক্রি কিংবা কাউকে বিপনন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
তবে বাস্তবিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে সিগারেট বা জর্দা বিক্রয়কর্মীর অনেকেই ১৮ বছরের নীচে। এছাড়া পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলেও আইন অনুসারে শাস্তির বিধান নেই বললেই চলে।
পালনের খাতিরেই তামাক বিরোধী দিবস
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘তামাক : পরিবেশ রক্ষায় বর্জন করি’। তবে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হলেও তামাকগ্রহণকারীর সংখ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি জাপান টোবাকো নতুন করে এই খাতে বিনিয়োগ করেছে।
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠী পণ্যের দামবৃদ্ধির প্রতি অধিক সংবেদনশীল। তামাকপণ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাকের ব্যবহার, তামাকজনিত মৃত্যু ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি অধিকহারে হ্রাস পায়। তাই তামাকে বর্ধিত করারোপ একটি দরিদ্র-বান্ধব পদক্ষেপ।
সর্বোপরি ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ অর্জন করতে হলে সিগারেটসহ সকল তামাকপণ্যের দাম সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে বৃদ্ধি করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা; বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে।