সাভার ইপিজেডে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনের সময় মারা যায় এক গার্মেন্টস শ্রমিক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে জানা যায়, নিহতের কানের নিচে ছোট কোন বস্তুর জোরালো আঘাত থেকে হওয়া জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর কারণে তার মৃত্যু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু নিহতের কারণ হিসেবে বিদ্যুতের খুঁটিতে আঘাতের কথা জানায় ডিইপিজেডের জিএম আব্দুস সোবহান এবং শিল্প পুলিশ।
জানা গেছে, নিহত শ্রমিকের নাম জেসমিন বেগম (৪০)। তিনি গোল্ডটেক্স কারখানায় জুনিয়র অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিহত জেসমিন আক্তারের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ার সেজুরিয়া গ্রামে।
নিহত জেসমিনের স্বামী মাহবুব জোয়ার্দার নিজেও একই কারখানায় সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল মর্গে উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'আমরা গরীব মানুষ, জেসমিন পুলিশের গুলিতে মরে যায়নি... পুলিশের গুলিতে মারা যায়নি। অফিসে যাচ্ছে, টিয়ারসেল মারসে, দৌড় দিসে। দৌড় দিতি গিয়ে কার্নিশের গায়ে লেগে মারা গেসে।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ সহকারী বাবুল বলেন, 'কানের নিচে কালো ছোট যখম। কানের নিচে কালো ছোট যখমে একটা মানুষ মইরা যাইবো! অনেক কথা শুনতেসি, এইডা কি ফাইজলামি? একটা মানুষ সুস্থ্য স্বাভাবিক বাসা থাইক্যা বাইর হইলো। রাস্তায় কালো ছিঁটা যখমে একজন মইরা যাইবো? আজকে পোস্ট মর্টেম হবে না।'
সাভারের ঢাকা ইপিজেডের সামনে আজ (১৩ জুন) সকাল আটটায় বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে সমবেত হয় বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন ধরে তারা বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলো। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ নেলি গার্মেন্টসের বেতন দেয়ার কথা ছিল বলে জানান শ্রমিক নেতারা। তাই অন্য কারখানা শ্রমিকদের সাথে নেলি গার্মেন্টসের ৬০০ শ্রমিক জড়ো হয় বকেয়া বেতন আদায়ের জন্যে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা এগারোটার দিকে পুলিশ টিয়ারশেল, জল কামান এবং লাঠিচার্জ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায় বলে দাবি শ্রমিক নেতাদের। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে শতাধিক শ্রমিক আহত হন এবং নিহত হন একজন নারী পোশাককর্মী।
আহত অবস্থায় ও-ই নারী পোশাককর্মীকে প্রথমে স্থানীয় হাবিব ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করলে ময়নাতদন্তের জন্যে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় জেসমিনের লাশ।
ঢাকা মেডিকেল মর্গে উপস্থিত নিহত জেসমিনের মেয়ের জামাই এবং পোশাক কারখানার শ্রমিক ফয়জুল শিকদার জানান, জেসমিনের কানের নিচে লাঠির আঘাত রয়েছে।
তবে কি লাঠির আঘাতে মারা গেছে জেসমিন? এমন প্রশ্নের জবাবে ইতস্তত হয়ে তিনি বলেন, 'পুলিশ লাঠি চার্জ করে নাই। গ্যাস ছাড়ছে। গ্যাস ছাড়াতে দৌড়াদৌড়ি হুড়োহুড়ি হইতে থাকে। তখন কই জানি আঘাত লাগসে। লাঠি চার্জ না করলে কই থাইক্যা আইল এই আঘাত? মনে হয় লাঠি চার্জ করসিল। কি হবে এইসব বইলা, যে মারা গেছে তারে আর ফিরা পাবো না। কথাবার্তা বললে ক্ষতিপূরণটাও পাবো না। কেমনে মারা গেসে আল্লাহ জানে।'
গার্মেন্ট শ্রমিক টিইউসির সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার জানান, জেসমিনের পরিবারের লোকদের ভয় দেখানো হচ্ছে। তারা কোন কথা বলতে চাচ্ছে না। এমনকি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বদলানোর চেষ্টা চলছে। বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশি হামলার নিন্দা জানাই। হামলাকারি পুলিশের বিচার চাই। হামলায় নিহত শ্রমিকের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
মর্গে উপস্থিত গুল্ডটেক্স গার্মেন্টসের সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা শাহিনকে জেসমিন আক্তার কিভাবে মারা গেছে জিজ্ঞেস করলে বেশ বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেন, 'ভাই, এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি। আমি আইসি গরিব মানুষ মারা গেসে তার লাশটা তাড়াতাড়ি ছাড়াইয়া দিতে। কীভাবে মারা গেসে আপনারাতো জানেনই। জেসমিন সকাল সকাল অফিস যাচ্ছিল। সেখানে পুলিশ টিয়ারগ্যাস আর গরম জল মারলে দৌড়াইয়া যাইতে গিয়া কই জানি বাড়ি খাইসে। হাজার হাজার শ্রমিক এর মাঝে কোথায় জানি বাড়ি খাইসে। আন্দোলনে পুলিশের হামলায় পালাতে গিয়ে রাস্তায় আঘাত পায়, তারপর তার মৃত্যু হয়।'