বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার সাক্ষী আল মারকাজুল ইসলাম বাংলাদেশ মাদ্রাসায় কর্মকর্তা মাওলানা আবদুর রশিদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দীতে বলেছেন, ‘সেদিন হাওয়া ভবনে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, লুৎফুজ্জামান বাবর, মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুর রহিমকে প্রবেশ করতে দেখি। সেখানে আগে থেকেই মুফতি হান্নান, মাওলানা তাইজুদ্দিনসহ অন্যরা অপেক্ষায় ছিল। আমি হাওয়া ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
আল মারকাজুল ইসলাম বাংলাদেশ মাদ্রাসায় কর্মরত মাওলানা আবদুর রশীদের আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে হাওয়া ভবন, তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আসামিদের বৈঠক ও পরিকল্পনার করার ঘটনার স্বপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আদালতে।
আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে মাওলানা আবদুর রশীদ বলেন, তার আত্মীয় মুফতি শহিদুল্লাহ তাকে আল মারকাজুল ইসলাম বাংলাদেশ মাদ্রাসায় চাকরি দেয়। সেখানে মাওলানা তাইজুদ্দিন, মুফতি হান্নান, শেখ সালাম, শেখ ফরিদ, মুফতি সফিকুর রহমানসহ অনেকে আসতেন। একদিন মাওলানা তাইজুদ্দিন, মুফতি হান্নানরা সেই মাদ্রাসায় যায়। সেখানে গিয়ে তারা বনানীর হাওয়া ভবনে যাওয়ার কথা বলে গাড়ি দিয়ে সহযোগিতার কথা বলে অনুরোধ জানায়। তাদের অনুরোধে মাদ্রাসার একটি গাড়ি করে আমিসহ (রশিদ) হাওয়া ভবনে যাই। আমাকে ভবনটির নিচে রেখে তাইজুদ্দিন ও হান্নান ভেতরে প্রবেশ করেন।
আমি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভবনে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, লৎফুজ্জামান বাবর, মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুর রহিমকে প্রবেশ করতে দেখি। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় মুফতি হান্নানসহ ১২ আসামি এ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী পেশ করেছে।
আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৫১১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির জ্যেষ্ঠ বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দসহ ২২৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আল মারকাজুল ইসলাম বাংলাদেশ মাদ্রাসায় কর্মরত মাওলানা আবদুর রশীদ হাওয়া ভবনে যাওয়ার ঘটনা সাক্ষী হিসেবে আদালতে বর্ণনা করেছেন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে সাক্ষী মাওলানা আবদুর রশিদের জবানবন্দীতে দেয়া এ সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলী সিনিয়র এ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। আদালতে দেয়া মাওলানা আবদুর রশিদের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী বনানীর হাওয়া ভবনে বৈঠকের বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়।
হাওয়া ভবনের ওই বৈঠকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অন্যদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন জঙ্গী সংগঠন হুজির প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান, গ্রেনেড সরবরাহকারী সাবেক মন্ত্রী পিন্টুর ভাই মাওলানা তাইজুদ্দিন। মাওলানা আবদুর রশিদ আদালতে সাক্ষ্যদানকালে হাওয়া ভবনে কারা উপস্থিত ছিলেন তা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে আদালতে তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় হুজি প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হুজি সদস্য মামলার অন্যতম আসামি জঙ্গী শরীফ সাইদুল আলম বিপুল, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাকের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও তুলে ধরা হয়। এই মামলার আসামি জঙ্গী শরীফ সাইদুল আলম বিপুলের জবানবন্দীতে বলেন, মুফতি হান্নানের কাছ থেকে গ্রেনেড নিয়ে সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়।
২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট ওই জঙ্গী আসামি ঢাকায় মুফতি হান্নানের সঙ্গে সাক্ষাত করে সিলেটের উদ্দেশে চলে যায়। ২০ আগস্ট ২০০৪ সালে তাকে মুফতি হান্নানের ভাই মহিবুলাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি ফোনে জানায় ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হবে। পরের দিন ২১ আগস্ট রাতে সে জানতে পারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় বহু হতাহত হয়েছে।
পরে মুফতি হান্নান ২১ আগস্টের ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত ঘটনা জানায় তাকে। মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১২ আসামি যারা ২১ আগস্ট ঘটনায় আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আসামি জঙ্গী শরীফ সাইদুল আলম বিপুল। ৎ
আদালতে দেয়া জবানবন্দীর বিবরণে জানা গেছে, হুজি প্রধান মুফতি আব্দুুল হান্ননের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী হুজির সদস্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার অন্যতম আসামি আরিফ হাসান সুমন তার জবানবন্দীতে বলেন, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাইজুদ্দিন জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদের ঢাকার প্রধান ছিলেন। তাইজুদ্দিন এ আসামির বাড়িতে ভাড়া থাকত এ সুবাদে তাইজুদ্দিনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তাইজুদ্দিনের কাছে অনেক পাকিস্তানী নাগরিক আসত।
এছাড়া মাওলানা হাফেজ আবু তাহের, মাওলানা মুনিরসহ অন্যরা তার কাছে আসত। ২১ আগস্ট ঘটনা বিষয়ে বিস্তারিত মাওলানা তাইজুদ্দিন জানে বলে আসামি সুমন তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষের চীফ প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান আদালতে বলেছেন, তারেক রহমানের তৎকালীন রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবন ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর সরকারী বাসভবনে এই গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্র করা হয়।
সাক্ষী ইউসুফের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী হুজি প্রধান মুফতি হান্নান জানায়, তারেক রহমান ২১ আগস্ট হামলা বাস্তবায়নে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। সে আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর তাদের সহায়তা দেন। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার চলছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে সাফাই গেয়ে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্ব শেষ পর্যায়ে এখন।
এরপরই এই মামলার বিচারকার্য শেষে রায়ের পর্বে পৌঁছাবে। আগামী মাসেই বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচারকার্য শেষ হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পতœী আইভি রহমান। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচন্ড শব্দে তার শ্রবণেন্দ্রীয় আঘাতপ্রাপ্ত হলে গুরুতর আহত হন। আহত হন তিন শতাধিকজন যাদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর আঘাত নিয়ে দুঃসহ যন্ত্রণার জীবনযাপন করে যাচ্ছেন।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক জনকন্ঠে)