কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাত ফসলের পাঁচটিতেই ব্যর্থতা

মেহেদী আল আমিন

আগস্ট ২২, ২০২৩, ০৬:৩৬ এএম

কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাত ফসলের পাঁচটিতেই ব্যর্থতা

বোরো ধানের চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২১৫.৩৩ লাখ টন হলেও ২১৮.৪৮ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। সংগৃহীত ছবি

প্রধান ফসলকে তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী সাত ভাগে ভাগ করে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অর্জনে বছরজুড়ে কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাত ক্যাটাগরির পাঁচটিতেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিষ্ঠানটি।

মোট ২৮টি ফসলকে দানাদার, কান্দাল, আঁশ, ডাল, তেল, মসলা এবং শাক-সবজি-এ সাত ভাগে ভাগ করে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে শাক-সবজি ও তেলজাতীয় ফসল ব্যতীত বাকি সবকটিতেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।

দানাদার ফসলের মধ্যে ভূট্টা, গম এবং বোরো ধানে লক্ষ্য অর্জন করতে সামর্থ্য হলেও আমন ও আউশে ব্যর্থতায় ৪৮৪.৯৮ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৪৭৭.৬৮ লাখ টন ফলন হয়েছে।

দানাদার ফসলের মধ্যে চাল (ধানের তথ্য চালে সংরক্ষণ করা হয়েছে) উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪১৫.৬৯ লাখ টন। তবে উৎপাদন হয়েছে ৪০১.৭৬ লাখ টন। চালে ঘাটতি ১৩.৯৩ লাখ টন।

তথ্য বলছে, ৩৬.৯০ লাখ টন আউশ ধানের চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও অর্জিত হয়েছে ২৯.০১ লাখ টন। এখানে ঘাটতি প্রায় ৭.৮৯ লাখ টন। আমনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬৩.৪৫ লাখ টনের মধ্যে অর্জিত হয়েছে ১৫৪.২৬ লাখ টন। ঘাটতি ৯.১৯ লাখ টন।  

তবে বোরো ধানের চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২১৫.৩৩ লাখ টন হলেও ২১৮.৪৮ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে।

এছাড়া দানাদার ফসলের মধ্যে গম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১১.৬০ লাখ টনের চেয়ে ১০ হাজার টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। আর ৫৭.৬৮ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ভূট্টা উৎপাদন হয়েছে ৬৪.২২ লাখ টন। ভূট্টা মূলত প্রাণী ও পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কান্দাল ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে ডিএই। এ ধরনের ফসলের মধ্যে রয়েছে গোল আলু ও মিষ্টি আলু। দুই ধরনের আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১১২.৩৯ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ১১০.৮৫ লাখ টন। গোল আলুর লক্ষ্যমাত্র ১০৫.৫৬ লাখ টনের মধ্যে অর্জিত হয়েছে ১০৪.৩১ লাখ টন। মিস্টি আলু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬.৮৩ লাখ টন আর উৎপাদন হয়েছে ৬.৫৩ লাখ টন।

আঁশ জাতীয় ফসলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পাট। পাট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। দেশি, তোষা, মেস্তা ও কেনাফ- এসব জাতের পাটের একত্রে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫.৫৫ লাখ বেল আর উৎপাদন হয়েছে ৮৪.৫৭ লাখ বেল।

ডাল আর মশলা জাতীয় ফসলের লক্ষ্য অর্জনেও এসেছে ব্যর্থতা। আট ধরনের ডালের ৯.৪৪ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও উৎপাদন হয়েছে ৮.৭৮ লাখ টন। আর মশলা জাতীয় ফসলের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২.৮১ লাখ টন আর উৎপাদন হয়েছে ৪৮.৭৫ লাখ টন।

তেলবীজ ও মশলা- এ দুই ধরনের ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ডিএই।

তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১৩.৭৮ লাখ টন অতিক্রম করে ১৬.০৪ লাখ টনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ১১.৬১ লাখ টনই সরিষা। সর্বশেষ ধরনের ফসলের মধ্যে শাকসবজি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২১২.৯৯ লাখ টন তবে উৎপাদন হয়েছে ২২৫. ৪০ লাখ টন।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএই’র সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, “ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও যে ফসলগুলো অধিক প্রয়োজন আর নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে আগানো হয়েছে, সে ফসলগুলো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে রয়েছে সরিষা আর শাক-সবজি।”

“আমরা পর্যায়ক্রমে একটার পর একটা ফসলে জোর দিয়ে প্রত্যেকটিতে যতটা সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কাজ করছি।”

তিনি বলেন, “দানাদার ফসলে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ আর সবজিতে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। তাই আমাদের প্রায়োরিটিতে রয়েছে তেল ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা ৪০ শতাংশে নিয়ে আসা।”

দানাদার ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা বলা হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৮. ৭৫ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে ৫ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ডিএই’র তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৩.৫৮ লাখ টন দানাদার শস্য আমদানি করেছে যা দেশের কৃষি পণ্য আমদানির শীর্ষে। এর পরেই ছিল ২৮.৭২ লাখ টন তেলজাতীয় পণ্য।

তাজুল বলেন, “সরিষা চাষে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে, সার ‍ও বীজ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়াও তেল জাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়াতে আলাদা একটি প্রকল্পই নেয়া হয়েছে। সেখান থেকেও কৃষকদের এসব সহায়তা করা হচ্ছে।”

কৃষক এবং কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য ফসলের তুলনায় তেল ও শাকসবজি-এ দুই ধরনের ফসলে মুনাফা বেশি হওয়ায় কৃষকরা অন্যান্য ফসলের পরিবর্তে এ ফসলগুলো চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা যাই হোক ফসল ফলানোর ব্যাপারে কৃষকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলার কৃষক মো. রেজওয়ান পাঁচ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছিলেন। সরিষার চাষ লাভজনক হওয়ায় ভবিষ্যতের অন্যন্য ফসলের জমিও সরিষা আবাদের আওতায় আনার কথা ভাবছেন তিনি।

রেজওয়ান বলেন, “ধান চাষ এখন কোনো লাভ হয় না। সরিষা খুবই লাভজনক ফসল। এখন প্রতি লিটার সরিষার তেলের বাজার মূল্য ৩৬০ টাকা। আগামীতে আমার ধানের জমিতেও সরিষা করব। এতে যদি এক মৌসুম ধান উৎপাদন বন্ধও থাকে তবুও লাভ।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “আমরা তো কৃষককে বলতে পারি না যে এ ফসল চাষ করেন না। কৃষক যেটি লাভবান মনে করবে সে ফসলই চাষ করবে। অধিদফতরের পক্ষ হতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পলিসি সাপোর্ট দেয়া হয়।”

Link copied!