বাজেট হচ্ছে একটি দেশের আসন্ন অর্থবছরের সম্ভাব্য আয় ও ব্যয়ের হিসাব। বিশ্বের প্রায় সকল দেশই প্রতি অর্থবছরে একটি আনুমানিক বাজেট পেশ করে থাকে। যা সেই দেশের সরকারের সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে চালানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। সরকার বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় কোষাগারে কত টাকা আসবে এবং সেসব অর্থের উৎস নির্ধারণ করে বাজেটের পাশাপাশি সেই অর্থের কত অংশ বিভিন্ন সরকারি বিভাগে বেতন হিসেবে দেওয়া হবে, কোন মেগা-প্রকল্পে কত টাকা খরচ হবে অর্থাৎ নাগরিক উন্নয়নে যাবতীয় কি করা হবে ও এতে কি পরিমাণ ব্যয় করা হবে তা পরিকল্পনা করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে ধারণা করা হতো, যে সরকার অর্থনীতিতে কম ব্যয় করার পাশাপাশি কম আয় করে, সে সরকারই সর্বোৎকৃষ্ট। দিনে দিনে অর্থ শাস্ত্রের উন্নতির ফলে বদলে গেছে এ ধারণা। আধুনিক অর্থনীতিতে যে সরকার যত বেশি আয় এবং সেই হারে ব্যয় করে সেই সরকারেই নাগরিকদের উন্নতি হয়। আর এটির অন্যতম একটি কারণ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ হতে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলো বর্তমানে ঘাটতি বাজেটের দিকে বেশি ঝুঁকছে।
ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বাজেটের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ব্যক্তি খরচের আগে আয়ের উৎস ও পরিমাণ নির্ধারণ করে ব্যয় করেন । তবে এর উল্টোটা করে থাকে রাষ্ট্র যা প্রথমে ব্যয় নির্ধারণ করে পরবর্তীতে আয়ের উৎস নির্ণয় করে। আর নিজস্ব উৎস দিয়ে এই ব্যয় মেটানো না গেলে বৈদেশিক ঋণ করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি। আর রাষ্ট্র চাইলে বছরের পর বছর ধরে এই ঋণের বোঝা টানতে পারে। কারণ রাষ্ট্র সাধারণত দেউলিয়া হয়না। রাষ্ট্রের বাজেটে আয় ও ব্যয় সমান হলে একে সুষম বাজেট বলে। যদিও এ ধরণের বাজেট বিশ্বে বর্তমানে দেখা যায় না। এ ছাড়াও বাজেটের আরও দুইটি ধরন রয়েছে, এগুলো হল উদ্বৃত্ত বাজেট ও ঘাটতি বাজেট।
ঘাটতি বাজেট কি?
সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়াকেই মূলত ঘাটতি বাজেট বলা হয়ে থাকে। সরকার নানা খাতে ব্যয় ও ভর্তুকি দিলেও এর আয়ের ক্ষেত্র সীমিত। যা থেকে সকল ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না বলেই ঘাটতি বাজেটে পেশ করা হয়। উন্নয়নশীল প্রায় সকল দেশই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এর কারণ হল, দেশের রাজস্ব ব্যয় ও রাজস্ব আয়ের পরেও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য বাজেটে একটি অংশ ঘাটতি রাখা হয়ে থাকে। আর এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে। যার ফলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ঘাটতি বাজেট অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, একটি দেশের ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ লাগামহীন হলে তা সেই দেশের উন্নয়নের অন্যতম বাধা হয়েও দাঁড়াতে পারে। একটি দেশের ঘাটতি বাজেট ঠিক কতটা হবে তা নির্ধারণ করে সেই দেশের জিডিপির ওপর। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর নির্দেশনা অনুসারে, একটি দেশের বাজেট সেই দেশের জিডিপি’র পাঁচ শতাংশের মধ্যে ঘাটতি রাখা উচিত। বাংলাদেশেও প্রতিবছর এই নির্দেশনা মেনে বাজেট পেশ করা হয়।
ঘাটতি বাজেটের গুরুত্ব
ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে একটি দেশের রাজস্বনীতির প্রত্যাশিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে ঘাটতি বাজেট অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কারণ এর মাধ্যমেই মূলত দেশটির অবকাঠামো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করা হয়। এসব খাত একটি দেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত অর্থ প্রবেশ করানো হয়। উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধির দ্বারা দেশে যেমন অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় তেমনি সেবা ও পণ্যের চাহিদাও বাড়তে থাকে। যার ফলে দেশের দারিদ্রতা দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠার পথ বিকশিত হয়। ঘাটতি বাজেট দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সরকারের জন্য এটি সাবধানতার সঙ্গে নির্দিষ্ট সীমার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঘাটতি বাজেট সাবধানতার সঙ্গে প্রণয়ন করা জরুরি।