নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার ১০ শতাংশ পেরিয়ে যাচ্ছে

এম মনিরুল আলম

জুন ১৮, ২০২৩, ০৬:৪৭ পিএম

গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার ১০ শতাংশ পেরিয়ে যাচ্ছে

সংগৃহীত ছবি

আবারও উচ্চসুদহারের যুগে প্রবেশ করলো দেশের ব্যাংকিং খাত। এতে করে ভোক্তাঋণ, সব পর্যায়ের উদ্যোক্তা ঋণ, শিল্পঋণ, আমদানি ও রপ্তানি ঋণসহ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেয়া ঋণেরও সুদহার বেড়ে যাবে। সে হিসেবে বিনিয়োগ ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ড বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া নতুন মুদ্রানীতি অনুয়ায়ী ঋণের এ সুদহার ১০ শতাংশ পেরিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ১৩ শতাংশ বা তারও অধিক হবে। 

এর কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতিতে বিদ্যমান সুদহারে ৯ শতাংশ ক্যাপ তুলে নিয়ে ‍‍‘করিডোর পদ্ধতি‍‍’ জারি করেছে। এতে করে ১৮২ দিন মেয়াদে ট্রেজারি বিলের (টি-বিল) বিপরীতে সুদহারের সাথে ব্যাংকগুলো ৩ শতাংশ স্প্রেড যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করবে। বর্তমানে এই টি-বিলের সুদহার ৭ দশমিক ১ শতাংশ। 

নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এ স্প্রেড পাঁচ শতাংশ। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণ ও ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ স্প্রেড এর সাথে আরও ১ শতাংশ ‍‍‘ঋণ তত্ত্বাবধান‍‍’ ব্যয় যোগ করতে পারবে। এছাড়া ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বিদ্যমান হারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

রবিবার (১৮ জুন) বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে নতুন এ মুদ্রানীতির মৌলিক বিষয়সমূহ তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান।

ড. হাবিব বলেন, ঋণের সুদহারে সূচিত করিডোর পদ্ধতিতে ১৮২ দিন মেয়াদী টি-বিলের সুদহারকে ‍‍‘রেফারেন্স রেট‍‍’ হিসেবে গণ্য করা হবে। তাই বাজারদর অনুযায়ী এ রেট বাড়লে ও কমলে ঋণের সুদহারও বাড়বে এবং কমবে।

এ পদ্ধতিকেই স্মার্ট (সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি-বিল) বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

টি-বিল এর বিদ্যমান ৭ দশমিক ১ শতাংশ সুদহারকে রেফারেন্স রেট ধরলে ব্যাংকঋণে ৩ শতাংশ স্প্রেড ও ১ শতাংশ সুপারভিশন বা তত্ত্বাবধান ব্যয় যোগ করে সুদহার দাঁড়ায় ১১ শতাংশের উপরে। আর নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ৭ দশমিক ১ শতাংশ রেফারেন্স রেট এর সাথে পাঁচ শতাংশ স্প্রেড ও ১ শতাংশ সুপারভিশন বা তত্ত্বাবধান ব্যয় যোগ করে এ সুদহার ১৩ শতাংশ পেরিয়ে যাবে।

এর আগে ব্যাংকঋণে সুদের হার খাতভেদে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। করোনার বছর ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদে ৯ শতাংশ ক্যাপ আরোপ করা হয়। দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটাতে বড়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ক্ষতি পুষিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনার অংশ হিসেবে এ ক্যাপ আরোপ করা হয়।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নতুন এ মুদ্রানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এ লক্ষ্যে সুদহারকে বাজারভিত্তিক করতে করিডোর বা স্মার্ট পদ্ধতি সূচনা করা হলো। এতে করে টাকার সরবরাহ ও চাহিদা বাজারভিত্তিক হবে। এটি মূল্যস্ফীতি কমাতে সহযোগিতা করবে। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত হবে।

সরকারের ব্যাংকঋণ ও আর্থিক নীতিমালা প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, সরকারের বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি হয়। এতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিনিয়োগ আসে এবং মোট জাতীয় উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়সৃজনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেজন্য নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারকে উন্নয়ন ব্যয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংকিং খাত থেকে সরবরাহ করা হবে।

এ মুদ্রানীতিকে কন্ট্রাকশনারী বা টাইট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে গভর্নর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে স্বল্প মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বাজারভিত্তিক করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। একইসাথে বৈদেশিক মুদ্রার একটি স্থিতিশীল রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাও সক্ষমতার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক করতে চায়। 

তিনি বলেন, ডলারের একধরনের ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য থাকবে। অর্থাৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি মূল্য থাকবে। এটি জুলাইয়ের শুরুতে নির্ধারণ করে দেয়া হবে। 

তিনি বলেন, বর্তমানে বিদ্যমান ডলারের বিনিময় মূল্য (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা) বাজারদরের কাছাকাছি রয়েছে। এটি খুব বেশি অবমূল্যায়িত হবে না।

রিজার্ভ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর শর্ত প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আমি বলব এটি শর্ত নয়। এটি একধরনের পার্টনারশিপ। তারা আমাদের অর্থ দেয়ার পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছে।

তিনি বলেন, রিজার্ভ এই মুহূর্তে ৩০ বিলিয়নের মতো আছে। জুনশেষে তাই থাকবে। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশের উপরে, রেমিট্যান্স বেড়েছে ২ শতাংশের মতো। এছাড়া, ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদিত বৈদেশিক ঋণ পাইপলাইনে আছে। আগামী অর্থবছরে এর চার ভাগের একভাগ বা সাড়ে ১২ বিলিয়ন ব্যয় করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।

মুডি‍‍’স এর বাংলাদেশ ঋণমান কমানো প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটি ভূরাজনৈতিক বিষয় হতে পারে। আমি এ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, মুডি‍‍’স ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়ে একই রেটিং দিয়েছে। অর্থনীতি ২০১২ এর তুলনায় অনেক এগিয়ে গেলেও রেটিং পরিবর্তন করেনি।

তিনি বলেন, তবে মুডি‍‍’স এর রেটিং নিয়ে আমাদের কিছু আসে যায় না। কারণ আমাদের কোনো সভেরিয়েন বন্ড নেই। এ রেটিং বৈদেশিক বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে এবং তারা তাদের প্রয়োজনে সুবিধাজনক স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিবে।

গভর্নর বলেন, আমেরিকার অর্থনীতি আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। সেখানে সুদহার কমবে। এ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্ট আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবে।

গভর্নর বলেন, দেশের ফাইনান্সিয়াল এ্যাকাউন্ট প্রথমবারের মতো নেতিবাচক হয়েছে। এটি আগামী অর্থবছরে ঠিক হয়ে যাবে। এর আগে সব সময় ফাইনান্সিয়াল এ্যাকাউন্ট সারপ্লাস থাকতো। বর্তমানে এ ঘাটতির পরিমান ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। আমাদের একটি বড় অর্জন হলো কারেন্ট এ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এ ঘাটতি অনেক কমে এসেছে। এ ঘাটতি বর্তমানে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বা পলিসি রেট বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুলাই থেকে রেপো রেট দশমিক ৫০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে হবে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর রিভার্স রেপো রেট দশমিক ২৫ পয়েন্ট বেড়ে হবে ৪ দশমিক ৫০ পয়েন্ট হবে।

নতুন মুদ্রানীতিতে কলমানি রেট ৮ দশমিক ৫০ শতাংশের উপরে উঠতে পারবে না। এ সিলিং কে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি রেট। বর্তমানে কলমানি রেট আছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি রেট সূচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংক বা নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের টাকা বিনিয়োগের সুযোগ না পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত রেখে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ মুনাফা গ্রহণ করতে পারবে।

Link copied!