শিক্ষার্থী নয়, ব্যবসাই মূল লক্ষ্য দোকানিদের

ন্যূনতম মৌলিক খাবারও মেলে না ঢাবি ক্যাম্পাসে

মাহমুদ নকীব

মার্চ ৯, ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম

ন্যূনতম মৌলিক খাবারও মেলে না ঢাবি ক্যাম্পাসে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে খাবারের মান ভালো নয়। ছবি: দ্য রিপোর্ট

খিঁচুড়ি, চপ, ফুচকা, তেলেভাজা স্যান্ডুইচ আর উচ্চমূল্যের ফ্রাইড রাইস- প্রভৃতি মুখরোচক খাবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর, মধুর ক্যান্টিন, ডাস, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও টিএসসির অনুমোদিত দোকানগুলোর প্রতিদিনের মেন্যু। পরিমাণে অল্প ও দামে বেশি এসব খাবারের বাইরে আর কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই অনাবাসিক প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে খাবার তদারকি কমিটি। অথচ তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। ফলে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার তো দূরের কথা, শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম মৌলিক খাবারের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ-ইনস্টিটিউটে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলে সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এর মধ্যে বিরতি থাকে কোথাও এক ঘণ্টা, কোথাও মাত্র ৪০ মিনিট। ফলে আশেপাশে এই দোকানগুলো ছাড়া দূরে গিয়ে খাওয়ারও সুযোগ থাকে না। এই সুযোগে নিজেদের মত অধিক দাম নির্ধারণ করে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪ হাজার ৮৯৫ জন। এর মধ্যে অফিসিয়ালি হলে থাকা আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ১৭৯ জন। বাকি প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর খাবারের উৎস এই দোকানগুলোই। শিক্ষার্থীদের বিবেচনায় দোকানগুলোর ভাড়াও নামেমাত্র। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে খাবার দোকান ও হাকিম চত্বরের দুইটি দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া পায় মাত্র ১১ হাজার ৫০০ টাকা করে! কিন্তু অল্প পরিমাণ খাবারে চাহিদার তিন ভাগের একভাগও পূরণ হয় না বলে অভিযোগ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আবার এসব খাবার শিক্ষার্থীদের ক্রয়ক্ষমতারও বাইরে।

খাদ্য সংকট নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুল আরিফিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবারের সার্বিক চিত্র মোটেও ভালো না। ক্যাম্পাসের খাবারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দুইটি ফ্যাক্টর-১. খাবারের মান ভালো না। খাবারের পুষ্টিমান একেবারেই কম। দেখা যায় একজন মানুষের দৈনিক যে পরিমাণ আমিষ প্রয়োজন সেই তুলনায় ক্যান্টিনগুলোর খাবারের অনেক বেশি ঘাটতি দেখা যায়। ফ্যাটের ঘাটতি না হলেও দেখা যায় যেসব ফ্যাট আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোই ছাত্রছাত্রীদের খেতে হচ্ছে। এছাড়া ক্যান্টিনের পঁচা বাসি খাবারগুলোর মধ্যে বিদ্যমান মাইক্রো বাইলোজিক্যাল সাইটগুলো শিক্ষার্থীদের অসুস্থ বানিয়ে দিচ্ছে ২ হাইজিন মেইনটেইন হয় না।’

গত কয়েকদিনে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাকিম চত্বরের দুটি দোকান ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে একটি খাবারের দোকানে পাওয়া যায় হরেক রকমের ভাজাপোড়া ও পানীয়। এসব দোকানে ৪৫ টাকায় খিচুড়ি, ৪৫ টাকায় ফ্রাইড রাইস, ১০-২৫ টাকায় চপ, টোস্ট, বন পাওয়া যায়। কিন্তু খিঁচুড়ি ও রাইসের পরিমাণ খুবই অল্প, যা দিয়ে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীর ক্ষুধা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জান্নাত তালবিয়া বলেন, ‘দুটি ক্লাসের মাঝখানে বিরতি খুবই কম হওয়ায় সময় বাঁচাতে লাইব্রেরির সামনে দোকানে খেতে হয়। কিন্তু পরিমাণে এতই কম যে, ক্ষুধা দূর হয় না। কিন্তু বিকল্প উপায় না থাকায় এসব খেয়েই চলতে হচ্ছে।’

আরেক শিক্ষার্থী হাসান ইমাম আক্ষেপ করেন নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে যখন আসি তখন আমার ওজন ছিল ৭২ কেজি। কিন্তু ক্যাম্পাসের এসব পঁচা বাঁশি খাবার খেতে খেতে ওজন কমে পৌঁছেছে ৬০ কেজিতে। কেউ দেখলেই জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তোর? অসুস্থ কিনা! ডাক্তার দেখিয়েছি, তিনি বলেছেন পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে। কিন্তু আমি থাকি হলে। পুরো ক্যাম্পাসেই ভালো খাবার নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় নিজের স্বাস্থ্য কিভাবে ঠিক রাখবেন এটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বলে জানান হাসান।

এদিকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে কফি হাটের চিত্র ভিন্ন। এখানে খাবারের দাম অত্যধিক। ১৪০ টাকায় ফ্রাইড রাইস, ১১০ টাকায় বার্গার, ১১০ টাকায় সাব-স্যান্ডুইজ, ১২০ টাকায় পাস্তা মেলে এখানে। যা শিক্ষার্থীদের নাগালের বাইরে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন খাবারের জন্য গড়ে ১৫০-২০০ টাকা খরচ করেন। সেই হিসেবে ১৪০ টাকায় দুপুরের খাবার খাওয়া তাদের জন্য পরিহাসই বটে।

আর ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর খ্যাত মধুর ক্যান্টিনের খাবার নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই।

যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দোকানগুলোতে চা বিক্রি হয় ৭ টাকায়, সিঙ্গাড়া বিক্রি হয় ৫ টাকায়, স্যান্ডউইচ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় আর সমুচা পাওয়া যায় ৫ টাকায়। সেখানে কোনো ধরনের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল না দিয়েও মধুর ক্যান্টিনে খাবারের তালিকা অনুযায়ী সিংগারা ১০ টাকা, সবজি রোল ২০ টাকা, সমুচা ১০ টাকা, স্যান্ডউইচ ৬৫ টাকা, শর্মা ৯০ টাকা, পুডিং ৪০ টাকা, পাটিসাপ্টা ২৫ টাকা, ব্রেড বাটার ৪০ টাকা, রং চা ১০ টাকা, ছানা ছোট ২ টুকরা ৪০ টাকা, ছোট ৫ পিচ মিষ্টি ৫০ টাকা প্লেট এবং কেক ১৫ টাকা দাম রাখা হয়।

এদিকে ডাসে খাবার দোকানে বিক্রি হচ্ছে নানা রকমের ফাস্ট ফুড ও মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার। এ দোকানে ১০০ টাকায় ৫ পিস মমো, ৬০-১১০ টাকায় বিভিন্ন জাতের বার্গার, ৯০ টাকায় বার্গার ও ১০০ টাকায় চিকেন ফ্রাই। উচ্চমূল্যের এসব স্ন্যাকস শিক্ষার্থীরা খান না। এসবের মূল ক্রেতা ঘুরতে আসা বহিরাগতরা।

তবে এসব দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। এসব দোকানের বেচাকেনা জনে উঠে বিকালের পর থেকেই। বহিরাগতরা এসে দোকানগুলোর মুখরোচক খাবার খেতে ভিড় করেন।

দোকানের কর্মচারীরা জানান, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে হলের শিক্ষার্থীরা তাদের দোকানে তেমন আসেন না। মূলত বাইরের মানুষজনই তাদের মূল কাস্টমার।

ওয়াহিদুল নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এসব খাবার দোকানে খুব একটা খাওয়া হয় না। কিন্তু যখনই খেতে যাই তখনই দেখি বহিরাগতদের ভিড় লেগেই আছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় নিজেদের ক্যাম্পাসে আমরা নিজেরাই বহিরাগত।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও অস্থায়ী দোকান পরিচালনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমেদ দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকান গুলো আমরা ভাড়া দিয়েছি। তবে এখানে খাবারের দাম ব্যবসায়ীরা নির্ধারণ করে। এসব তদারকির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

ক্যাম্পাসের খাবারের মান তদারকির বিষয়ক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘ব্যাপারটি নিয়ে আমরাও অবগত রয়েছি। এ বিষয়ে কী করা যায় দেখি।’

সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘খাবার নিয়ে সংকটের কথা আমরা জানতে পেরেছি। খাবারের দাম, মান আমরা প্রক্টরিয়াল টিমকে পাঠিয়ে খবর নিবো অসুবিধার বিষয়টি।’

Link copied!