মোমেনা আক্তার মিরপুর থেকে এসেছেন তার ছেলে মোহাইমিনকে নিয়ে। চার বছরের সময়ই তার সন্তানের ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। বাবা মা কারও কোন ডায়াবেটিস না থাকলে সন্তানের কিভাবে হয় সে বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে জানতে পারেন ডায়াবেটিস টাইপ ২ এর কথা। যেখানে বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস না থাকলেও সন্তানের ডায়াবেটিস হতে পারে।
শিশুদের ডায়াবেটিস হয় এই কথাই যেন মেনে নিতে পারছেন না অনেক অভিভাবক। টাইপ ১ ডায়াবেটিস জন্মগত হলেও দেশে ঝুঁকি বাড়ছে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের। ফাস্টফুড থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অত্যধিক ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে পারে এই ডায়াবেটিসের।
বাংলাদেশের গবেষকরা বলছেন, দেশটিতে শিশুদের ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত ১২ বছরে বেড়েছে প্রায় ৯ গুণ। বারডেম পরিচালিত শিশু বিষয়ক ‘চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন’ বা সিডিআইসি কর্মসূচির মাধ্যমে এদের চিকিৎসা দেয়া হয়।
সাধারণত শিশুকাল থেকে যাদের ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় তাদের ২৬ বছর পর্যন্ত এই কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির প্রথমবছরেই বেশ সাড়া ফেলে। ২০১০ সালে সেখানে চিকিৎসা নিতে রেজিস্টার্ড হয়েছিল ৯১৩ জন শিশু কিশোর। ২০১১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ২ হাজার ৮১ তে। ২০১২ সালে ২ হাজার ৮১৩ জন চিকিৎসা নেয়।
প্রতিবছরই প্রায় ৫০০ জন নতুন শিশু ও কিশোর ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার জন্য রেজিস্টার্ড হতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৬৭ জন। ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে ৮ হাজার ৮৩ জন।
২০২১ সালে আন্তর্জাতিক একটি জার্নালে শিশুদের ডায়াবেটিস নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলায় ২০ বছর থেকে কম বয়সী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পরিচালিত গবেষণায় ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিসের তথ্য রেকর্ড করা হয়। এই সময়ে ৭২৫টি জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
এতে টাইপ-১ ডায়াবেটিস পাওয়া গেছে ৪৮২ জনের, যা শতকরা বিবেচনায় ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ। টাইপ-২ ডায়াবেটিস পাওয়া গেছে ২০৫ জনের, যা শতকরা বিবেচনায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়াও ফাইব্রোক্যালকুলাস প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিস পাওয়া গেছে ১৪ জনের দেহে, যা ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসের অন্যান্য ধরণ ছিল ২৪ জনের, যা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের ডায়াবেটিস পরবর্তী সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো চোখের সমস্যা। চিকিৎসকদের মতে, ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুদের সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রিফ্লেক্টিভ এরর বা দৃষ্টির ত্রুটি। অর্থাৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুরা একটা সময়ে দূরে এবং কাছ থেকে চোখে ঝাপসা দেখে।
চোখের সমস্যা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) পেডিয়াট্রিক ডায়াবেটিস কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও বিশিষ্ট চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে তেমন কোনো কাজ করা হয়নি। তবে গত দুই বছরে আমাদের বারডেম হাসপাতালে নরডিস্ক ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ইউএসএইডের অর্থায়নে আমরা একটি মডেল প্রজেক্ট পরিচালনা করছি। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুকে আমরা স্ক্রিনিং করেছি।
এদিকে আক্রান্ত শিশুর বাকি জীবন বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন গ্রহণ করতে হয়। সিডিআইসিতে গিয়ে দেখা যায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি আত্মোন্নয়নের নানারকম প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। এজন্য সেখানে একটি আলাদা কামরাও রয়েছে। সেই কামরায় গিয়ে মূলত শিশুকাল থেকেই যারা চিকিৎসা নিচ্ছে তারা আড্ডাও দেন। এদের বেশিরভাগই বহু বছর ধরে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
চলমান গবেষণার তথ্য অনুসারে টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ে উঠে আসে বেশ কিছু ঝুঁকির দিক। ২০১০ সালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে যেসব শিশু সিডিআইসির শরণাপন্ন হত, তাদের ২ শতাংশ থাকত টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর ২০১৬ সালে এসে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের শিশুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশ। ২০২৩ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস পুরোপুরি ইনসুলিন নির্ভর। আমরা জানি দেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন হলো ইনসুলিন। টাইপ-১ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পার্থক্যটাই হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ইনসুলিন লাগতেও পারে আবার নাও লাগতে পারে। টাইপ-২ তে মানুষের দেহে ইনসুলিন তৈরি হয়, কিন্তু এটি দেহে ঠিকমতো ফাংশন করে না। আর যখনই দেহের ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ না করে বা নিয়মিত নতুন করে তৈরি না হয়, তখনই বাইরে থেকে ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস লাইফস্টাইল মোডিফিকেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু টাইপ-১ এর ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। কারণ এই প্রকৃতির ডায়াবেটিসে কেউ আক্রান্ত হলে তার দেহে ইনসুলিন তৈরিই হয় না। এই অবস্থায় বেঁচে থাকতে হলে ইনসুলিন গ্রহণই তার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।
সিডিআইসি কর্মসূচীর কনসালটেন্ট-কো-অর্ডিনেটর ড. বেদৌরা জাবীন দ্য রিপোর্টকে জানান টাইপ-১ ডায়াবেটিসের পাশাপাশি আজকাল বহু শিশুকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে দেখছেন, যেটি মূলত হয় অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও পরিশ্রম করতে অনীহার কারণে।
ড. বেদৌরা জাবীন আরও বলছেন, টাইপ-১ ডায়াবেটিস কেন হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এনিয়ে কেউ কিছুই বলতে পারছে না। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পেছনে একটি বড় কারণ জেনেটিক। পরিবারে আমার বাবা-মায়ের আছে, এক্ষেত্রে আমার সম্ভাবনাটা বেশি। এছাড়াও স্থুলতা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি বড় কারণ। তবে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে এটি কোনো ম্যাটার করে না।
শিশুদের সেবা প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে আসলে টাইপ-১ ক্ষেত্রে ন্যাশনাল কোনো রেজিস্ট্রি নেই। টাইপ-২ ক্ষেত্রেও নেই, তবে এরইমধ্যে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন একটি রেজিস্ট্রি করে ফেলেছে। আর টাইপ-১ নিয়ে আমাদের দুটি প্রোগ্রাম চালু আছে। একটি হলো চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রাম, আরেকটি হলো লাইফ ফর এ চাইল্ড প্রোগ্রাম। এই দুটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা সারা বাংলাদেশ কভার করি। সারাদেশে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির ৩৪টি সেন্টারের মাধ্যমে আমরা সারাদেশের শিশুদের সেবা দিয়ে থাকি।