সরকার যুদ্ধংদেহী হলেও পাকিস্তানের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চান না: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৫, ২০২৫, ০৬:৩৪ পিএম

সরকার যুদ্ধংদেহী হলেও পাকিস্তানের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চান না: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সাঁজোয়া যানের বহর সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। আকাশে যুদ্ধবিমান ছুটে বেড়াচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় প্রচারিত হচ্ছে সংঘাতের আশঙ্কা বার্তা। জাতীয় নেতারা যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের কড়া জবাব দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান যখন যুদ্ধংদেহী গর্জন তুলছে, তখন দেশটির অবসাদগ্রস্ত সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করাকে দেশের জন্য সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় হিসেবে দেখছেন।

সরকারি বক্তব্য আর জনগণের ক্লান্তির মধ্যকার এ ফারাক থেকে স্পষ্ট, পাকিস্তান এখন আরও গভীর ভঙ্গুর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক হতাশা দেশটির নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো এবং বাসাবাড়িতে যুদ্ধ বা সীমানা নিয়ে আলোচনার তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, প্রতিনিধিত্বহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অনিশ্চয়তায় ঢাকা ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে।

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় দুই দেশের দীর্ঘদিনের শত্রুতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ হামলার এক সপ্তাহ পর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অধ্যয়নরত ২১ বছর বয়সী তাহসিন জাহরা বলছিলেন, ‘এটা আমাকে অস্থির করে তোলে।’

তাহসিন আরও বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি, নেতারা শুধু শক্তি প্রদর্শন করতে চান। এমনিতেই আমাদের অনেক সমস্যা আছে। এর ভেতর যুদ্ধ নিয়ে এত কথা বলাটা খুব বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। আমাদের শান্তি দরকার, নতুন কোনো ঝামেলা নয়।’

এই পাকিস্তানি শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় আমার পরিবারের জন্য শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ রাজনীতিবিদদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা অনেক বেশি কথা বলেন। কিন্তু আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন দেখি না। মনে হয়, তারা বুঝতেই পারেন না, মানুষ কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’

যারা এখনো দেশপ্রেমে অটল আছেন, তাদের মধ্যেও দেশের সামনে থাকা বিশাল বাধাগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।

ইসলামাবাদের ২৫ বছর বয়সী আরেক শিক্ষার্থী ইনামুল্লাহ বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশ এখন অনেক দুর্বল। কারণ, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের পেছনের দিকে টেনে নিচ্ছে।’

তবু পাকিস্তানের নাগরিকেরা আশ্চর্য রকমের সহনশীল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধকে ব্যঙ্গ করে তৈরি মিম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। যেগুলো মাঝেসাঝে অনেক পাকিস্তানির চোখে ভারতীয়দের ‘যুদ্ধবাজ মনোভাবকে’ উপহাস করে বানানো। এ ধরনের কালো কৌতুক বা হাস্যরসকে অনেকে মানসিক চাপ সামলানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন।

লাহোর শহরের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাভেরিয়া শাহজাদ বলেন, হ্যাঁ, এটিকে সহনশীলতা বলা যায়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মনোযোগবিচ্যুতিও বটে।

শাহজাদ বলেন, গত কয়েক বছরে তিনি তার রোগীদের মধ্যে এক গভীর হতাশা লক্ষ করেছেন। তার মতে, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে এবং দেশ এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।’

পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু সীমান্ত রক্ষা নয়; বরং পর্দার আড়াল থেকে দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করছে তারা। এটি ঐতিহাসিকভাবে জনগণের গভীর আনুগত্য অর্জন করেছে এবং জাতীয় সংকটকালে, যেমন ভারতের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

২০১৯ সালে যখন ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্যকে হত্যা করে এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে, তখনো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন ছিল প্রবল।

সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক বিভাজন

পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত এখনো অস্থির। পাকিস্তানি তালেবান ও আফগান তালেবান যোদ্ধারা হামলার মাত্রা বাড়িয়েছেন। চলতি সপ্তাহে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, আফগান সীমান্তের কাছে অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে টানা দুই রাতের অভিযানে তারা ৫৪ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে। দেশটির দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে স্বল্পমাত্রার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিদ্রোহ বহু বছর ধরে চললেও সম্প্রতি তা আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

দেশটির অর্থনৈতিক সংকট জনগণের উদ্বেগকে আরও তীব্র করে তুলেছে। সম্প্রতি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে আরেকটি সহায়তা চুক্তি নিশ্চিত করেছে। এ সহায়তা পাওয়ার পর বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত সাধারণ মানুষকে স্বস্তি পাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন। তবে অনেক পাকিস্তানির কাছে এসব অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দূরের ও ধীরগতির ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।

পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব বলেছেন, ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার জেরে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কা দেশের নাজুক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ‘সহায়ক হবে না’।

পাকিস্তানের অনেক নাগরিকের কাছেই এখন জীবিকা নির্বাহের সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংঘাতের আশঙ্কা একই বোঝার অংশ হয়ে উঠেছে। এ যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে।

নীলম উপত্যকায় অবস্থিত একসময়ের জমজমাট পর্যটন শহর কেরান এখন প্রায় জনশূন্য। অতিথিশালাগুলো নীরব। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর সীমান্তপারের এ অঞ্চলে আর পর্যটকেরা আসছেন না।

রাজা আমজাদ একজন পর্যটন ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটকদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি, তার প্রয়োজনও নেই। তিনি বলেন, ‘মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না। কেউ আসছে না।’

কাশ্মীরকে বিভক্ত করা তথাকথিত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি অবস্থিত আথমাকাম শহরের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী সাদিয়া বিবি তার বাড়ির পেছনে থাকা একটি বাংকার পরিষ্কার করেছেন।

সাদিয়া বলছিলেন, ‘এখনো গুলিবর্ষণ শুরু হয়নি। কিন্তু যেকোনো সময় শুরু হতে পারে। আমার বাচ্চাদের জন্য আমি এটা প্রস্তুত করে রাখছি।’

দেশজুড়ে অনেক পাকিস্তানিই এখন কেবল দেশ ছেড়ে যাওয়ার ভাবনায় আশার আলো খুঁজে পান।

ইসলামাবাদে করপোরেট খাতে কর্মরত ৩১ বছর বয়সী জারা খান বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগের জন্য কষ্টদায়ক ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের মতো দমবন্ধ পরিবেশে স্বাধীনভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। আমাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই, চাকরির বাজারের অবস্থা খুবই করুণ। একটি পরিবার গড়ে তোলার স্বপ্ন এখন অনেক দূরের স্বপ্ন।’

জারা খান আরও বলেন, ‘এখানে বাস করা চরম হতাশাজনক বিষয়।’

সূত্র: প্রথম আলো

Link copied!