তালেবান কর্তৃক আফগান জয়ের পর নানা শঙ্কা-আশঙ্কা বিরাজ করছে বিশ্বজুড়ে। কখন কী হয়! এই উদ্বেগের যথার্থতা প্রমাণ দিতেই যেন প্রতিনিয়ত দেশত্যাগী আফগানদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত তারা। তবে, আফগানরা জীবন নিয়ে বেশি শঙ্কিত হলেও বিশ্ব নেতারা বরং আফগানিস্তানে থাকা খনিজ সম্পদ নিয়ে বেশি চিন্তিত। কি হবে তালেবান দখলে থাকা আফগানিস্তানের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলার সমমূল্যের খনিজ সম্পদের?
মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ স্থলে থাকা এই ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে গত ১৯ ও ২০ শতক জুড়ে গ্রেট গেমের আবির্ভাব হয়েছিল ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে। তাদের সেই বৈরিতা শেষ হতে না হতেই আফগান দখল করেছিল মার্কিন সেনারা। কিন্তু কেন? শুধুই কি গণতন্ত্র আনা? সন্ত্রাসবাদ উৎখাত করা? উত্তর, সম্ভবত না। কেন না? তার জবাব লুকিয়ে আছে মার্কিন সামরিক বাহিনী ও তাদের ভূতাত্ত্বিকদের করা এক সার্ভেতে। ২০১০ সালে পরিচালিত সেই সার্ভে হতে দেখা যায়, আফগানিস্তান অন্তত ১ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ আছে। এখন প্রশ্ন হল, কী ভবিষ্যৎ এই সম্পদের? তালেবান কী করবে এই সম্পদ নিয়ে?
দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে লোহা, স্বর্ণ ও তামার মজুদ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের একটি হল লিথিয়াম ধাতু। ধারণা করা হয়, এই লিথিয়ামের সবচেয়ে বড় মজুদ রয়েছে আফগানিস্তানে। আছে কোবাল্টের মতো বিরল কিছু ধাতুর মজুদও।
বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক রড শনোভারের মতে, ‘কোন সন্দেহ নেই যে, আফগানিস্তানে এমনসব খনিজ আছে যা আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য খুবই জরুরী’। তবে দুর্বল অবকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ মারাত্মক খরা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এসব খনিজ উত্তোলন কখনোই গতি পায়নি। তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন কোন সম্ভাবনাও নেই। তবে চীন, পাকিস্তান এবং ভারত এই পট পরিবর্তনকে কিভাবে কাজে লাগায় সেটাই এখন বিরাট প্রশ্ন।
গত মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি জানিয়েছে, বিশ্বে লিথিয়াম, কোবাল্টসহ অন্যান্য বিরল মৃত্তিকা মৌলের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এসব মৌলের যোগানের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এবং এদের মজুদও প্রায় ফুরিয়ে আসছে।
বর্তমানে আফগানিস্তানে খনিগুলো থেকে বছরে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের খনিজ উত্তোলন করা হয়। এবং এর ৩০-৪০ শতাংশ অর্থ বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এবং তালেবানরা দখল করে নেয়। ফলে দেশের মানুষের কাজে আসে খুবই সামান্য অংশ। তবে বিশেষজ্ঞদের আশাবাদ, আফগানিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসলে এবং অন্যান্য দেশগুলোকে আফগানে বিনিয়োগ করার জন্য প্রবেশ করতে দেয়া হলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাবে। কেনান এসব খনিজ উত্তোলন এবং ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি ও দক্ষতা তালেবানের নেই।
বিশ্লেষক রড শনোভাবের মত, আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এই সুযোগ ভালোমতোই ব্যবহার করবে চীন। কেননা চীন এর আগে জানিয়েছে, তারা তালেবানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। আফগানিস্তানের নিকট প্রতিবেশী চীন বিশ্বে গ্রিন ও রিচার্জেবল এনার্জিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এমনকি তাদের কাছে আফগানিস্তানে থাকা খনিজগুলো উত্তোলনের প্রযুক্তি ও দক্ষতা আছে। এই ক্ষেত্রে চীন অন্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। ফলে আফগানিস্তানে যদি তালেবান চীনকে প্রবেশাধিকার দেয় তার পিছুপিছু পাকিস্তানও হয়তো ঢুকে পড়বে। কেননা, তালেবানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক পুরনো এবং চীনেরও পরিক্ষিত বন্ধু পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র আবার আফগানিস্তানে ঢুকতে পারবে কিনা এবং ঢুকলে কিভাবে ঢুকবে এবং তাদের সাথে তালেবানের সম্পর্ক কেমন হবে সেটাও আলোচনার অবকাশ রাখে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাড়ে ৯০০ কোটি ডলার আটকে দিয়েছে। ফলে তালেবানের সাথে যে, মার্কিনীদের সম্পর্ক খুব একটা ইতিবাচক নয় বুঝাই যাচ্ছে। সবমিলিয়ে, চীন হয়তো আফগানিস্তানে থাকা খনিজ উত্তোলন এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে প্রাধান্য পাবে। তবে, তালেবান সবে যাত্রা শুরু করেছে। সময় বলে দেবে তালেবান এবং তাদের অধিকারে থাকা আফগান রাষ্ট্র ও খনিজগুলোর ভবিষ্যৎ কি হবে।
(সিএনএন অবলম্বনে)