১৯ জুলাই

একদিনের সহিংসতায় নিহত ৬৭, সারা দেশে কারফিউ জারি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ১৯, ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম

একদিনের সহিংসতায় নিহত ৬৭, সারা দেশে কারফিউ জারি

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার একদিনে অন্তত ৬৭ জন নিহত হওয়ার পর ১৯ জুলাই ২০২৪ মধ্যরাতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সরকার।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ডাকাসম্পূর্ণ অবরোধ’-এর দ্বিতীয় দিনে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সেদিন সন্ধ্যায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর এই ঘোষণা আসে। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, কারফিউ চলাকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ‍‍`দেখামাত্র গুলি‍‍` নীতিতে চলবে।

নিউ এইজ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ জুলাই থেকে চলমান এই আন্দোলনে মোট নিহতের সংখ্যা অন্তত ১১২ জনে পৌঁছায়, যার মধ্যে ১৯ জুলাই একদিনেই প্রাণ হারান ৬৭ জন। নিহতদের মধ্যে আন্দোলনকারী, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক রয়েছেন।

আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়াবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা সেদিন দেশব্যাপী দ্বিতীয় দিনের জন্য অবরোধ পালন করছিল। আন্দোলনে বিএনপি তার সহযোগী সংগঠনগুলোর কর্মীরাও অংশ নেয়, ফলে সহিংসতা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।

শুধু ঢাকায়ই অন্তত ৬২ জন নিহত হন। এছাড়া রংপুর, সাভার, সিলেট নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলায় আরও হতাহতের ঘটনা ঘটে। দৈনিক সমকাল-এর এক প্রতিবেদনে রাজধানীর বাইরে আরও অন্তত ১২ জন নিহতের কথা বলা হয়, যার মধ্যে পাঁচজন রংপুরে।

ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুই হাজারের বেশি আহত আন্দোলনকারীকে ভর্তি করা হয়। তবে অভিযোগ উঠেছে, সরকারি নির্দেশে অনেক হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। নিহতদের স্বজনরাও এমন অভিযোগ করেন।

সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা বিআরটিএ সদর দপ্তর, পিবিআই অফিস, এবং মেট্রোরেল স্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়। কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রো রেল সেবা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে দূরপাল্লার বাস ট্রেন যোগাযোগও। বাতিল হয় একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট।

রাজধানীর রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বাড্ডা মহাখালিসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে রণক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, ্যাবের হেলিকপ্টার থেকে রামপুরা যাত্রাবাড়ীতে গুলি চালানো হয়, যদিও ্যাব তা অস্বীকার করেছে।

ঢাকার বাইরে খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী গাজীপুরেও ব্যাপক সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। নরসিংদীতে বিক্ষোভকারীরা জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে জেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিম্মি করে কয়েদিদের মুক্ত করে দেয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

সহিংসতার মধ্যে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ২৪ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। শাহবাগেসন্তানের পাশে অভিভাবকব্যানারে অভিভাবকরাও আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে মানববন্ধন করেন।

সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। দলের নেতা ওবায়দুল কাদের বিএনপি-জামায়াতকে নৈরাজ্যের উস্কানিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। অন্যদিকে বিএনপি এই ছাত্র আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করতে গিয়ে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ছাত্ররা সরকারের নতুন সংলাপ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে নয় দফা দাবি ঘোষণা করে। দাবিগুলোর মধ্যে ছিলপ্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য ক্ষমা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের আইজিপির পদত্যাগ, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া।

ওই রাত ৯টা থেকে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে ডিজিটাল যোগাযোগ সংবাদ প্রবাহ স্থবির হয়ে পড়ে। মধ্যরাতে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাহিদ ইসলামকে ঢাকার একটি এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

কারফিউ, গ্রেপ্তার, নিপীড়ন ইন্টারনেট বন্ধের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। ১৯ জুলাইয়ের এই ভয়াবহ দিনটি ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং রাষ্ট্র জনতার মধ্যে বিভাজন আরও ঘনীভূত করে।

Link copied!