পূর্ব পাকিস্তানে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ

হাসনাত আসিফ কুশল

মার্চ ২৬, ২০২৪, ১২:২৬ এএম

পূর্ব পাকিস্তানে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ

যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। ১ মার্চ, ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর ২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পালিত হতে থাকে পূর্ণ ও অর্ধ-দিবস ধর্মঘট। একই সঙ্গে কারাগার থেকে বন্দী পালানোর ঘটনাও ঘটতে থাকে। পাকিস্তানের রাজনীতি তখন ঘোঁলাটে রূপ ধারণ করেছে।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কে হবেন- তা নিয়ে ভুট্টো ও মুজিবের বনিবনা না হওয়ায় টানাপোড়েন বাড়ছিল। ইয়াহিয়া খান ছিলেন দুমুখো সাপের ভূমিকায়। একদিকে তিনি যেমন মুজিবকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রেসিডেন্ট’ বলে কালক্ষেপণ করছেন, অন্যদিকে ভুট্টোকেও অভয় দিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই ৭ মার্চ কবি শোনালেন তার অমর কবিতা গাঁথা- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেই ১৬ মার্চ শুরু হয় আলোচনার নামে কালক্ষেপণ। মুজিবের সঙ্গে আলোচনার ভান করে চলতে থাকে ইয়াহিয়া খানের ভণ্ডামি।

১৫ মার্চ, ১৯৭১, সোমবার: পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তবে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।

১৬ মার্চ ১৯৭১, মঙ্গলবার: অসহযোগ আন্দোলনের নবম দিন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক। ধানমন্ডি থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনের উদ্দেশে একটি সাদা গাড়িতে চড়ে তাতে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। গাড়ির সামনে ছিল বাঙালি হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদস্বরূপ কালো পতাকা আর উইন্ড স্ক্রিনে মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ও দলীয় প্রতীক নৌকা।

এই বৈঠক শুরু হয় সকাল ১০টায়। শেষ হয় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আরও আলোচনা হবে। কাল সকালে আমরা আবার বসছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই।’

১৭ মার্চ ১৯৭১, বুধবার: ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যথারীতি বৈঠকে বসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। ছয় দফা দাবিতে অটল থাকেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মুক্তিকামী জনতা রাজপথে নেমে আসে।

বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে ধরেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আলোচনার ফলাফল বলার সময় আসেনি।’

১৮ মার্চ ১৯৭১, বৃহস্পতিবার: ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো হয় মুক্তিকামী জনতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিছিল নিয়ে আসতে থাকে তারা। এদিন জনতার উদ্দেশে শেখ মুজিব বলেন, ‘তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলো। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে, তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পালটা আঘাত হেনো। জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তিসংগ্রামের পতাকা আরও ওপরে তুলে ধরো। ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’

দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তান থেকে সৈন্য আরও আনার বিষয়ে আপনি কিছু জানেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বলেন, ‘আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে তার সব খবরই আমি রাখি।’

১৯ মার্চ ১৯৭১, শুক্রবার: আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তারা দুজন ছাড়া সেখানে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে নিজ বাসভবনে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। ধানমন্ডিতে সাংবাদিকদের জানান, তিনি জানান, পরদিন সকালে আবার বৈঠক হবে। তবে সে বৈঠক একান্ত হবে না। দলের শীর্ষ নেতারা তাঁর সঙ্গে থাকবেন। এর আগে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁর দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলোচনায় বসবেন।

একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, মানুষকে সব সময় ‘জয় বাংলা’ বলে সম্ভাষণ জানানোর কারণ কী। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি মুসলমান। সকালে ঘুম থেকে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করার পরই আমি জয় বাংলা বলি। মৃত্যুর সময় আমি আল্লাহর নাম নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে ইহধাম থেকে বিদায় নিতে চাই।’

২০ মার্চ ১৯৭১, শনিবার: কঠোর সামরিক নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকার রমনায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বৈঠক হয়। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টার ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদেরকে শেখ মুজিব বলেন, ‘আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি এসেছে। সময় হলেই সব জানিয়ে দেবো।’

২১ মার্চ ১৯৭১, রোববার: এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এক অনির্ধারিত বৈঠক হয়। ৭০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয় এ বৈঠক। এতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আকস্মিক বা আশ্চর্যজনক কিছু নয়। আগে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে উদ্ভূত কিছু বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা গ্রহণের প্রয়োজনেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।’

২২ মার্চ ১৯৭১, সোমবার: এদিন ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন ইয়াহিয়া খান। ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে হঠাৎই যোগ দেন জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পিপিপির অন্যান্য নেতারা।

সোয়া এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’

২৩-২৪ মার্চ ১৯৭১, মঙ্গলবার-বুধবার: ইতিহাসবেত্তা ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান কীভাবে প্রণীত হবে তার রূপরেখা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

২৩ মার্চ এ বিষয়ে একটি খসড়া ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের হাতে পৌঁছে। ২৪ মার্চ সেটা চূড়ান্ত বিষয়ে জানাতে আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনকে ফোন করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করেননি পাকিস্তানি কর্মকর্তারা।

২৫ মার্চ ১৯৭১, বৃহস্পতিবার: পাকিস্তানি কর্মকর্তারা টেলিফোন করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা তো করেইনি। বরং এদিন পূর্ব পাকিস্তানে হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আগেভাগে জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ অন্যান্য নেতারা ঢাকা ত্যাগ করেন। সন্ধ্যায় গোপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পালিয়ে যান।

Link copied!