পাটকলে একযুগেই ক্ষতি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ৬, ২০২২, ০৮:১৯ পিএম

পাটকলে একযুগেই ক্ষতি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা

গৌরবের সোনালি আঁশ এখন অর্থনীতির দায়ে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলোতে লোকসান ও ভর্তুকিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে এই খাতে আয় না হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া পাটের জীবন রহস্য আবিষ্কার ও বহুমুখী ব্যবহারের সকল উপকরণ থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে না।

১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়

১০ বছরে সরকারের ২৫টি জুট মিলে লোকসান দিতে হয়েছে ৪ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। আর জুট মিলসহ সামগ্রিকভাবে পাট খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। দুর্নীতি-অনিয়মসহ নানা সীমাবদ্ধতায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে বাংলাদেশে পাটের জীবন রহস্য আবিষ্কারের পর নতুন করে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নানা উদ্যোগের কথা বলছে সরকার। পাট খাতের এ দুরবস্থার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অদক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, শ্রমিক ইউনিয়নের স্বেচ্ছাচারিতা, সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাব এবং সরকারের অবহেলা।

আবিষ্কারেই সীমাবদ্ধ পাটশিল্প

২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে সিনথেটিক পণ্য নিষিদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বায়োডাইবারফিকেশন ব্যাগ ও পণ্যের চাহিদা। যা বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ২০১৩ সালে দেশীয় পাটের জন্মরহস্য আবিষ্কার করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। এছাড়া পাট থেকে খাদ্য জ্যাম, জেলী ইত্যাদি উৎপাদন করার প্রক্রিয়া করা হয়। কিন্তু কোন কিছুই আলোর মুখ দেখেনি। কেনাফ ৩ পাট বীজ থেকে ৪০ শতাংশ ভোজ্যতেল আহরণ করা গেলেও তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়নি। 

ফলে জীবাণপ্রতিরোধক পাট উৎপাদন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দেশি পাট দিয়ে বস্ত্রশিল্পের উপযোগী সুতা উৎপাদন করাও সম্ভব। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতেই নানা উদ্যোগ। এদিকে পলিথিনের মোড়ক ব্যবহার করে পণ্য বাজারজাত করে এমন কোম্পানির ওপর এক শতাংশ ইকো ট্যাক্স আরোপ করা হয়। অবৈধ পলিথিন নির্মূল ও পলিথিন রি-সাইক্লিংয়ের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, বিশ্বে পলিথিনের ব্যবহার বাড়লেও টেকসই উন্নয়নের যুগে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এ কারণে পাটকে নিয়ে বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার। এরমধ্যে রয়েছে-পাট পণ্যের প্রসার ও বাজার সম্প্রসারণ, পাটচাষি পাটপণ্যের উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের সহায়তা, বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উদ্যোক্তা এবং পাটজাত পণ্যের ব্যবহারের বাড়ানো। 

বেসরকারিভাবে রপ্তানি বাড়বে

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১১৬ দশমিক ১৪ লাখ ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪২ কোটি ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৬ কোটি ডলার বেশি। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে প্রতিবছর ১২ দশমিক ৩৫ লাখ একর জমিতে পাট চাষ হয়। এতে মোট উৎপাদনের পরিমাণ ৮০ লাখের বেশি। মোট উৎপাদনের ৭৫ শতাংশই দেশে ব্যবহার হয়। বর্তমানে দেশে জুট মিলের সংখ্যা ২০৩টি। এরমধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় ২৫টি। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) আওতায় ৮১টি এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় ৯৭টি। সরকারি হিসাবে তিন খাতে মোট শ্রমিক ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪৯।

সরকারি ৮২ পাটকল থেকে এখন শূণ্য

১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আদমজী পাটকল। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে গড়ে ওঠে অনেক পাটকল যার বেশিরভাগই ছিল লাভজনক। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমে ৬৭টি পাটকলকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। পরে আরও পাটকল সরকারি করে বিজেএমসির আওতায় আনা হয় মোট ৮২টি পাটকলকে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর নেতৃত্ব ও কর্মপরিকল্পনায় কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনা কখনো হয়নি, যা ক্রমশ পাটকলগুলোকে দুর্বল করেছে।

২০০২ সালে আদমজী জুট মিলস বন্ধ করা হয়। এরপর বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীনে বর্তমানে পাটকল আছে ৩২টি। ৫টি মিলের মামলা আদালতে বিচারাধীন। একটিতে ভিসকোস উৎপাদন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আর একটিতে বিক্রয়োত্তর মামলা রয়েছে। সর্বশেষ তিনটি নন-জুট মিলসহ সচল ছিল ২৫টি। তবে অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। মিলগুলো বন্ধ থাকায় গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে স্বেচ্ছায় অবসর বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে শ্রমিকদের পাওনা নগদ ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে। ৪টি মিলের (জাতীয়, খালিশপুর, দৌলতপুর ও কেএফডি) মিলের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে। বন্ধ থাকা এসব জুটমিলের মধ্যে ১৭টি ইজারা দিচ্ছে সরকার। এসব মিলগুলোর ৫টি চট্টগ্রাম অঞ্চলের, ঢাকা অঞ্চলের ৪টি ও খুলনা অঞ্চলের ৮টি। বিজেএমসির তথ্যানুযায়ী, ঢাকা জোনে পাটকল ৭টি। যার মধ্যে চারটি ইজারা দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম জোনে মিল ১০টি, যার মধ্যে পাঁচটি ইজারা দেওয়া হবে।

Link copied!