বাংলা নাটক দেখতে ভালোবাসে আবেগপ্রবণ বাঙালি। নাটকের প্রেম, ক্লাইমেক্স, অ্যাকশন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্র কখনও কখনও আমুদে দর্শকদের মনে গেঁথে থাকে আজীবন। বাঙালি দর্শকরা নাটককে বিনোদন হিসেবে দেখলেও কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে শিক্ষামূলক। বিনোদনের মধ্য দিয়ে অনেক নাটকই আমাদের জীবনমূখী শিক্ষা দিয়ে যায়।
কখনও কখনও নাটকের ঘটনা ছাপিয়ে বাস্তবেও তার প্রভাব রেখে যায় বাঙালি দর্শকরা। নব্বইয়ের দশকে তেমনই ঘটনা ঘটেছিল হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে। বাকের ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। বদির দেওয়া রাজসাক্ষ্য অনুযায়ী বিচারক বাকের ভাইকে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনান। কিন্তু নাটকের এই রায় মেনে নিতে পারেনি এদেশের আপামর দর্শক। বিটিভিতে এর শেষ পর্ব দেখানোর পরদিনই প্রতিবাদস্বরূপ রাস্তায় নামে তারা। প্রযোজক বরকতউল্লাহর বাসার জানালার কাঁচ ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে দেখে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তো হুমায়ূন আহমেদকে বলেই বসলেন, “বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কি কোনোভাবেই এড়ানো যায় না?”
নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন এড়ানো সম্ভব নয়- তার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন নন্দিত এই নাট্যকার।
পাশাপাশি নাটককে লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও উপস্থাপন করে থাকেন অনেকে। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষকে একবার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “নাটকে লোকশিক্ষে হয়”। কথাটা শুনে গিরিশচন্দ্র কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে ছিলেন। কেননা তার বিশ্বাস ছিল নাটক বিনোদনের মাধ্যম। এতে লোকশিক্ষে হবে কি করে? ঠাকুরকে সাহস করে বলেও ছিলেন। জবাবে ঠাকুর বলেছিলেন, “চৈতন্যলীলা দেখে মানুষ শ্রী চৈতন্যের মতো ভক্ত হতে শেখে। প্রহ্লাদচরিত্র দেখে মানুষ শেখে কেমন করে ভগবানকে পেতে হয়। তো এতে লোকশিক্ষে হবে না তো আর কিসে হবে?”
নাটকে লোকশিক্ষে হয়- ঠাকুরের এই বাক্য আজকের এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমৃদ্ধি ও অধুনা স্মার্ট যুগে এসেও ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়নি। আজও অনেক ভালো ভালো নাটক তৈরি হয়। ভালো ভালো পরিচালক দর্শকদের উপহার দিয়ে যাচ্ছেন ভালো ভালো নাটক। এসব নাটক যেমন বিনোদনের, তেমনই শিক্ষামূলকও বটে। যে নাটক দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়, সেই নাটক সার্থক। আজকাল ইউটিউবেও অনেক অনেক বাংলা নাটক ছাড়া হচ্ছে। এসবে শিক্ষামূলক ও বিনোদন দুটোরই সমন্বয় করা হয়েছে। তবে এখন আর কথা না বাড়িয়ে মাস সেরা তিনটি বাংলা নাটকে ঘুরে আসি। চলুন হারিয়ে যাই বাংলা নাট্য জগতে-
মাথাগরম জামাই
শ্বশুর বাড়িতে এসে মাথাগরম জামাই সবার সঙ্গে কেমন অসদাচরণ করে থাকেন, তা এই নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের সবাইকে সদাচরণের শিক্ষাও দেয় এটি।
শুরুতে দেখা যায়, প্রাইভেটকার থেকে জামাই নামছে। সঙ্গে নেমেছে বউ। শ্বশুর বাড়ি এসে বউয়ের সামনে শ্বশুর-শাশুড়ির নিন্দা করছে জামাই। তা সত্ত্বেও মুখ বুজে সব সয়ে যাচ্ছে বউ। জামাই অকাতরে বউকে বাবা তুলে গালমন্দ করছে। শ্বশুর-শাশুড়িকেও ছাড়ছে না। সামান্য মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই- তাতেও শ্বশুর বাড়ির দোষ। একপর্যায়ে তো জামাই শ্বশুরকে পাঁচতলা বাড়ি করে দেওয়ারও প্রস্তাব দিলো। না, বদান্যতা নয়। লোকদেখানো দান। নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য, নিজের সুবিধার আশায়, যাতে প্রতিবছর তাকে গ্রামে এসে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়, সেই আশায় শ্বশুরকে বাড়ি করে দেওয়ার কথা বলে। এ জন্য কন্ট্রাক্টরও নিয়ে আসে জামাই। কিন্তু এটা শ্বশুরের আত্মসম্মানে বাঁধে। বাদ সাধল শ্বশুর। জামাইও শ্বশুর-শাশুড়িকে বংশ তুলে গালমন্দ করতে থাকে।
নাটকের শেষে আছে ক্লাইমেক্স। না সেটা বলবো না। এর জন্য আপনাকে অবশ্যই নাটকটি দেখতে হবে। গত ঈদুল ফিতরে বাংলাভিশনে নাটকটি প্রচারিত হয়। এরপর ২৮ এপ্রিল ইউটিউবে ছাড়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯৯ জন দর্শক এটা দেখেছেন।
অভিনয়ে ছিলেন মোশাররফ করিম, জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি, হান্নান শেলি, শেলি আহসান, শৈশব আমেরী, আল আমিন সবুজ, মহসিন আকাশসহ আরও অনেকে। নাটকটি রচনা করেছেন আল আমিন স্বপন। এছাড়া সহযোগী পরিচালক মহসিন আকাশ ও সহকারী পরিচালক আলী হোসাইন। চিত্রগ্রহণ করেছেন এস আর নিহাদ। সম্পাদনা ও রং বিন্যাস করেছেন মো. ইমাম হাসান। পোস্ট প্রোডাকশন: জি এস ফিল্ম হাউস।
প্রতিশোধ-২
এটা মূলত একটি নাটিকা। এর উপজীব্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্কের রসায়ন। গ্রাম্য প্রেম, পরকীয়া ও দাম্পত্য সম্পর্কের ট্যুইস্ট নাটকটি। এতে যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু অভিনয়ে তারা বেশ পরিপক্ক। কাঁচা হাতের কাজও মনে হয়নি।
নাটকটির প্লট স্ত্রীর পরকীয়াকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। স্ত্রী পরকীয়া করে এবং প্রায়শই অন্য একটি ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। স্বামী এ কারণে তার বান্ধবীদের বাসায় এনে স্ত্রীকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঘুরতে বেরোয়। এভাবেই এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনী। ইউটিউবে ১ কোটি ১৯ লাখ ২৭ হাজার ৯৯৬ জন দর্শক ১৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের নাটিকাটি উপভোগ করেছেন। গত ১৮ এপ্রিল নাটকটি ভিডিও ব্লগিং প্ল্যাটফর্মটিতে ছাড়া হয়।
গেস্ট ইন সিঙ্গাপুর
অনামিকা মণ্ডলের চিত্রনাট্য ও হাসিব হোসেন রাখি পরিচালিত নাটক গেস্ট ইন সিঙ্গাপুর। নাটকটির শুরুতেই একজন গৃহবধূকে পথের ধারে দেখা যায়। তার পরনে ছিল লাল-কমলা মিশ্রিত শাড়ি। তাকে উচ্চস্বরে কাঁদতে দেখা যায়। স্বামীর জন্য কাঁদছে। মনে হচ্ছে যেন তার স্বামী তাকে ফেলে চলে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই দর্শক তেমনই ধরে নিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই নাটকের দৃশ্যে তার স্বামীকে দেখা যায়। তাদের গন্তব্য ছেলেবেলার এক বন্ধুর বাসা। স্বামী চায় তার বন্ধুকে সারপ্রাইজ দিতে।
বন্ধুর বাসায় গিয়ে অপ্রত্যাশিত মেহমান হওয়ার বিড়ম্বনা। বন্ধুর স্ত্রী কাউকেই চেনে না। এভাবেই এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনী। এতে অভিনয়ে ছিলেন নিলয় আলমগীর, জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি, সাইদুর রহমান পাভেল, মুকিত জাকারিয়া, শামন্তী সৌমীসহ আরও অনেকে। সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন বিশ্বজিৎ দত্ত ও মাসুম আহমেদ। সম্পাদনা ও রং বিন্যাস করেছেন আকাশ সরকার। নাটকটির সংগীতের আয়োজনে ছিল অ্যাপল মাহমুদ এমিল। গত ঈদুল ফিতরে নাটকটি বাংলাভিশনে প্রচারিত হয়। এরপর ২২ এপ্রিল নাটকটি ইউটিউবে ছাড়া হয়।
সুন্দরী
নাটকটিতে সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র হলো সুন্দরী। পুরো নাটক জুড়ে এই রহস্য চলতে থাকে। সুন্দরী হলো একজন ঘোটকী। বিয়ে ঠিক করেই সে আয় করে। একটা গুণ্ডা পরিবারের সঙ্গে ওই ঘোটকীর আলাপ হয়। বিনিময়ে পারিশ্রমিকও নেয়। যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে গুণ্ডা পরিবারের নিরীহ মেয়ের বিয়ে হয় সেই ছেলেকে ঘটনাচক্রে ভালো লেগে যায় ঘোটকীর। সে কথা বলতে এগোবে সে, কিন্তু ছেলেটি কোনোভাবেই বোঝে না।
ঘোটকী কি আদৌ সেই ছেলেকে পেয়েছে? নিশ্চয়ই আপনার মনে এই প্রশ্ন উঠছে। তার জন্য ক্লাইমেক্সে অর্থাৎ চূড়ান্ত উত্তেজনার মুহূর্ত পর্যন্ত আপনাকে নাটকটি দেখতে হবে।
মেজবাহ উদ্দীন সুমনের রচনায় নাটকটিতে অভিনয় করেছেন তৌসিফ মাহবুব, কেয়া পায়েল, শামিমা নাজনীন, মাহমুদুর রহমান মিঠু (বদা মিঠু), ফারুক আহমেদ, মিলি বাসার, শম্পা নিজাম, এম কে এইচ পামির, হিমি হাফিজ, সিয়াম নাসির, রিধিকা ঋধি, মুরসালিন রাইদ, জিন্নাত রেহমান লুনা, আনিকা খাঁক, নাফিজা আক্তার, অনিতা অকিল, মাসুম মিয়া, ইলা আহমেদ, জাহিদ চৌধুরী, সিদ্দিক মাস্টার, মিঠু, রফিক মিয়া, রুবেল, ফয়সাল, হাসিবুল, তানভির, স্বপ্নীল, রিপন, খায়ের, সিরাজ, পুনম, জারিফ ও জান্নাত। নির্মাতা রুবেল হাসান, প্রধান সহকারী পরিচালক কাজী বাহাদুর হিমু, সহকারী পরিচালক শিশির আহমেদ ও মোস্তফা, চিত্রগ্রহণ কামরুল ইসলাম শুভ, আবহ সঙ্গীত নাজির মাহমুদ এবং তার দল, সম্পাদনা ও রং বিন্যাস অঞ্জন শুভ, স্থিরচিত্র অপূর্ব অভি, পোস্টার ডিজাইন নাহিদ হোসেন এবং প্রযোজক শেখ সাহেদ আলী (পাপ্পু)। নাটকটি প্রযোজনা করেছে সেন্ট্রাল মিউজিক অ্যান্ড ভিডিও (সিএমভি)।
গত ২৪ এপ্রিল ইউটিউবে নাটকটি ছাড়া হয়। ১ ঘণ্টা ২২ মিনিট ১৭ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের নাটকটি দেখেছেন ৯৩ লাখ ২৫ হাজার ৭৫৭ জন দর্শক। নাটকটি গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে উন্মুক্ত করা হয়।
বোকা প্রেমিক
অসম প্রেম নিয়ে স্যাটায়ার কমেডি। বোকা প্রেমিক নাটিকায় একটি ব্যর্থ প্রেমের আখ্যান দেখানো হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল এই নাটিকা ইউটিউবে উন্মুক্ত করা হয়। এখনও পর্যন্ত এর দর্শক সংখ্যা ৮৫ লাখ ৮০ হাজার ৬২১। এতে সব পাত্রপাত্রীই অপ্রাপ্তবয়স্ক। তবে অভিনয়ে তারা সিদ্ধ। নাটিকাটির দৈর্ঘ্য ১২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড।
তোমাতে হারাই
তোমাতে হারাই রোমান্টিক ঘরানার নাটক। সুপার শপের একজন নারী বিক্রয়কর্মীকে একবার দেখে প্রেমে পড়ে যায় এই নাটকের নায়ক। এরপর ঘটনা সামনের দিকে এগোতে থাকে। গত ১৯ এপ্রিল ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে নাটকটি উন্মুক্ত করা হয়।
১ ঘণ্টা ৪ মিনিট ৩ সেকেন্ডের নাটকটিতে অভিনয়ে ছিলেন মুশফিক আর ফারহান, আয়শা খান, দীপা খন্দকারসহ অন্যরা। চিত্রনাট্য পাপ্পু রাজ, পরিচালনা মো. তৌফিকুল ইসলাম, প্রযোজক এস কে শাহেদ আলী এবং প্রযোজনা সেন্ট্রাল মিউজিক অ্যান্ড ভিডিও। নাটকটি এখনও পর্যন্ত ৬৮ লাখ ৬৬ হাজার ২৮৬ জন দেখেছেন।