বসন্তের ভালবাসায় ১৪ ফেব্রুয়ারি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২, ০৩:১২ পিএম

বসন্তের ভালবাসায় ১৪ ফেব্রুয়ারি

হাতে একগুচ্ছ গোলাপ অথবা গাধাফুলে গাথা মালা, পরণে পাঞ্জাবী, গলায় ঝোলানো উত্তরীয়, চুলে হাল্কা জেলি দিয়ে অপেক্ষা প্রেয়সীর। বসন্তে অথবা বিশ্ব ভালবাসা দিবসে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের সামনে কিংবা প্রিয়জনের বাড়ির সামনে অপেক্ষরত বাঙ্গালী প্রেমিক পুরুষদের সম্পর্কে কারাই বা না জানে! প্রেয়সী হয়ত ইচ্ছা করে অথবা নেহাতই সাজ সজ্জার অজুহাতে সময়ও একটু বেশি নেন। হয়ত বসন্তের হলুদ আর ভালবাসা দিবসের লাল রং রাঙ্গা পাঞ্জাবীতে অপেক্ষারত প্রেমিকের জন্য একটি বছর মনে মনে তারাও অপেক্ষা করে থাকেন! এমন আবেদন নিয়ে আবারো প্রকৃতিতে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত।

ঋতুবৈচিত্রের বাংলায় বসন্ত বরাবরই আসে প্রকৃতির অপরুপ সাজ নিয়ে। প্রকৃতির হলুদ সাজে সাজ মিলিয়ে সাজেন নারীরাও। হলুদ প্রকৃতিতে নারীর হলুদ শাড়ি হলদে রংয়ে রাঙ্গিয়ে তোলে আমাদের আবহমান ষড়ঋতুর বাংলাকে। বসন্তের এ বাহারী রুপের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে বিশ্ব ভালবাসা দিবস। 

কৃষ্ণচুড়ার ডাল লালে লাল। শিমুল ফোটা পলাশ রাঙা দিনে কোকিলের কুহুতানে মুখরিত রূপসী বাংলার বিস্তীর্ণ উঠান। বৃক্ষরাজির পুরনো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পত্রপল্লবে শোভিত প্রকৃতির চাদর। দখিনা সমীরণের উত্তাপ কানে কানে বলে দেয় ফাগুন যে এসেছে ধরায়। ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।'

আজ পয়লা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। ‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়/ ফুল ফুটেছে বনে বনে/ শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায় ফাল্গুনী মোর মন বনে-গানে ও সুরে’। দ্রোহ, প্রেম, চেতনার কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই তার কবিতায় তুলে ধরেছেন বসন্তের উচ্ছ্বাস। দখিনা সমীরণে ফাল্গুনী হাওয়া উদাস করে প্রেমিকের কোমল হৃদয়ে ভালোবাসার ঢেউ তুলেছে ঋতুরাজ।

মডেল সাফা কবির ও নাহিদ

একই সঙ্গে আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ফাল্গুনী হাওয়ায় ভালোবাসার উত্তাপে প্রেমিক-প্রেমিকা একাকার সারা দেশ। বাসন্তী আবিরের সঙ্গে খোঁপায় হলুদ গাঁদা আর মাথায় ফুলের টায়রায় শরীরী সুষমার শৈল্পিকতা ফুটে উঠেছে তারুণ্যের ভাঁজে ভাঁজে। বাসন্তী রঙের তরুণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তরুণরাও কম যাচ্ছেন না। আবহমান বাংলার বাসন্তীদের হৃদয়ে তরুণরাও ধরা দিয়েছে একরাশ বসন্তের সাজে। শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে তরুণ-তরুণীর বাঁধভাঙা উল্লাসে আজ নতুনভাবে সেজে উঠেছে সারা দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা, শিল্পকলা একাডেমি, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বলধা গার্ডেন, বেইলি রোডের ফাস্টফুডের দোকান, ধানমন্ডি লেক, রবীন্দ্র সরোবরে ছড়িয়ে গেছে ভালোবাসা ও বসন্তের মিছিল।

বাংলা বর্ষপঞ্জির পয়লা ফাল্গুন আর গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলে গেছে। তাই বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস মিলেমিশে একাকার। প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার করে ত্রুটিমুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত করে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে সমন্বয় করেছে বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি। এর ফলেই এ বছর থেকে পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস একই দিনে পড়ছে।

“মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৮ ফাল্গুন। কিন্তু সাধারণত ২১ ফেব্রুয়ারি পড়ত ৯ ফাল্গুন। একইভাবে মহান বিজয় দিবস ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল পয়লা পৌষ, বাংলা পঞ্জিকায় দিনটি পড়ত ২ পৌষ। কবিগুরুর জন্মদিন ২৫ বৈশাখ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে মিলত না। এই বিশৃঙ্খলা দূর করে দুই বর্ষপঞ্জির মধ্যে দিন গণনার সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন, স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ১২ চৈত্র, বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর পয়লা পৌষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী ৮ মে ২৫ বৈশাখ, নজরুল জয়ন্তী ২৫ মে ১১ জৈষ্ঠ এমন করে সব বিশেষ দিবসগুলো বাংলা ও গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির দিন গণনায় অভিন্ন হচ্ছে। গত ২০১৯ সাল থেকে দুই পঞ্জিকার এই সমন্বয় করা হয়েছে। আগে পয়লা ফাল্গুন পড়ত ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে, আর ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পরের দিন । এখন পঞ্জিকা সংস্কার করায় পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস একই দিনেপড়ছে

১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে অন্যতম বসন্ত উৎসব। ১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যাত্রা শুরু করে বসন্ত উৎসব, যা ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’ নামেই পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশে এর গোড়াপত্তন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছোট্ট পরিসরে শুরু হয় বসন্ত উৎসব। এ আন্দোলনের বিজয় উদযাপনের জন্য বানিয়ে রাখা রঙিন কাগজের ফুল, প্রজাপতি আর পাখির অবয়ব নিয়ে চারুকলা অনুষদের ৮৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করেন। পরে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এর আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় শুরু হয় বসন্ত উৎসব।

 
Link copied!