মার্চ ১৩, ২০২৫, ০১:৪৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
আজ ১৩ মার্চ সন্ত্রাসবিরোধী রাজু দিবস। ১৯৯২ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন মঈন হোসেন রাজু। তার স্মৃতিকে জীবন্ত রাখতে টিএসসির সড়কদ্বীপে নির্মাণ করা হয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য। রাজুকে বলা হয় ক্যাম্পাসের প্রমিথিউস। গ্রিক পুরানের প্রমিথিউস যেমন দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনে পৃথিবীর মানুষকে দিয়েছিলেন। মানুষকে এনে দিয়েছিলেন প্রযুক্তি, জ্ঞান ও সভ্যতার আলো। তেমনি রাজুও বিশ্ববিদ্যালয়কে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জীবন। ১৩ মার্চ রাজুর মৃত্যুবার্ষিকীতে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের বিশেষ আয়োজন।
“ওই তোরা রাজুতে আয়” –এই কথাটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুল চর্চিত একটি বাক্য। “ওই তোরা রাজুতে আয়” বলে কেউ যখন ডাক দেয়, তখন আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনের সড়ক মোড়ে অবস্থিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের’ কথা বলা হয়।
যে রক্তক্ষয়ী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে, সেই অভ্যুত্থানেরও প্রাণকেন্দ্র ছিল এই ‘রাজু ভাস্কর্য’।
যে রাজু ভাস্কর্য ঘিরে এতো আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগ-তীতিক্ষার গল্প, সেই ‘রাজু’ আসলে কে ছিলেন? ভাস্কর্যটাই-বা কিভাবে ও কবে নির্মাণ করা হলো? এর পেছনের গল্পটা কী? জানবো সেসব কথা।
রাজু কে ছিলেন?
ভাস্কর্য কথা বলে- ভাস্কর্য সাহসের প্রতীক হয়ে লড়াই সংগ্রামের প্রেরণা যোগায়। এরকমই একটি ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য -প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আন্দোলন-সংগ্রামের পীঠস্থান হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
যার স্মরণে এই ভাস্কর্যটি তৈরি হয়েছিল, তার পুরো নাম মঈন হোসেন রাজু। ১৯৬৮ সালের ২৯ জুলাই বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে জন্মেছিলেন তিনি। তার পরিবার প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ঢাকায় থাকার সময় তিনি স্কুলজীবনেই যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ১৯৮৭ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকতেন শহীদুল্লাহ হলের মূল ভবনের ১২২ নং কক্ষে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রাজু
রাজু! –একজন জলজ্যন্ত মানুষ থেকে তার ভাস্কর্যে পরিণত হওয়ার পেছনের গল্পটা একই সঙ্গে বেদনাদায়ক, অনুপ্রেরণা ও সাহসের।
নব্বইয়ের দশকে ক্যাম্পাসে তখনো ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। যে-কোন ধরণের সন্ত্রাসের বিপক্ষে রাজু ছিল সবসময় প্রতিবাদমুখর।
১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। দিনটি ছিল শুক্রবার। রাজু মাকে কথা দিয়েছিল দুপুরে খেতে যাবে তাদের শ্যামলীর বাসায়। কিন্তু ঘাতকের বুলেট রাজুকে আর যেতে দেয়নি।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে’ মিছিল সংগঠিত করে রাজু। মিছিলে স্লোগান ছিল “অস্ত্র শিক্ষা, এক সাথে চলবে না”, “অস্ত্রবাজি সন্ত্রাস, রুখে দাঁড়াও ছাত্র সমাজ”।
মিছিলটি টিএসসি সড়ক দু’পাক দেবার পর ডাসে’র সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হাকিম চত্বর থেকে এক পক্ষের সন্ত্রাসীরা মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। তবুও মিছিলের স্লোগান বন্ধ হয় না। একটি গুলি রাজুর মাথায় লাগে। স্লোগানরত রাজু লুটিয়ে পড়ে পিচ ঢালা রাস্তার ওপর।
রাজু ভাস্কর্য যেভাবে নির্মিত হল
সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার স্বপ্ন দেখা এ মৃত্যুঞ্জয়ী এ বীর সেনানীর স্মরণে প্রাথমিকভাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয় স্বোপার্জিত স্বাধীনতার পশ্চিম দিকে যেখানে গুলিবিদ্ধ হন রাজু। শহীদ হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ স্থানকে চারিদিক ইট দিয়ে বৃত্তাকারে চিহ্নিত করা হয়।
পরে শহীদ মঈন হোসেন রাজুর শহীদি আত্মবলিদানকে স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনের সড়ক মোড়ে তৈরি করা হয় ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য’।
এই ভাস্কর্যের ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল। নির্মাণ ও স্থাপনের অর্থায়নে ছিলেন –ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান ও মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি, লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। ভাস্কর্যটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
রাজু ভাস্কর্য নির্মাণ সহজ কাজ ছিল না। অনেক বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন। প্রতিবছর ১৩ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু দিবস পালন করা হয়।
পুরানের পাখি
কবি শামসুর রাহমান শহীদ মঈন হোসেন রাজুকে নিয়ে লিখেছিলেন কবিতা “পুরানের পাখি”। রাজু প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন ‘পুরানের পাখি’, যাকে “…যতই পুড়িয়ে ভস্ম করা হোক হিংসার আগুনে, বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসে পুরাণের পাখি হয়ে।