ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
শৈশবে যে মানুষটি আমাদের ট্রেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি আর কেউ নন, শামসুর রাহমান। পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নেওয়া এই নাগরিক কবি ছোটবেলায় বড় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবেন এমন কোন নিদর্শন দেখাননি। তার পরিবার তার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি করে দেয়নি। শামসুর রাহমান তার আত্মজীবনী কালের ধুলোয় লেখাতে উল্লেখ করেছেন, তার পরিবারে বই পত্রের প্রচলন খুব একটা ছিল না। বলতে গেলে ছিলই না। তার বই পড়ার এবং কেনার অভ্যাস গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন। তার সকল আবদার ছিল তার মায়ের কাছে। মায়ের কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে বই কিনতেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। মা তাকে জিজ্ঞেস করতেন, আর কতো বই কিনবি? এত বই পড়া লাগে তোর?
বাবার সঙ্গে পুত্রের সদ্ভাব না থাকলেও দূরত্ব ছিল না। মূলত বাবার প্রবল প্রতাপ ব্যক্তিত্বের নিজেকে ম্লান মনে করতেন নিজেকে। একবার তার বাবা মুখলেছুর রহমান নামাজ পড়ছিলেন, শিশু শামসুর বা বাচ্চু বাবার নামাজের সামনে সামনে দিয়ে বার কয়েক না খেয়াল করেই দৌঁড়াদৌড়ি করেছিলেন। নামাজ শেষে বাবা শিশু বাচ্চুর কান মলে দিয়েছিলেন। যতোটা না শাস্তিতে তারচেয়ে বেশি শাস্তির ভয়েই শামসুর রাহমান তার কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলেন। শৈশব শুরু করেছিলেন, পোগোজ স্কুল থেকে। তারপর বেশ লম্বা পথ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি অনার্স শেষ করেন। মাস্টার্স শুরু করেও শেষ করা হয়নি আর। তবে শৈশবে বাবুবাজারের এক আঁকিয়ে নাঈম মিয়ার কাছে তালিম নিতে শুরু করেছিলেন আঁকাআঁকির। আঁকাআঁকি বলতে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’, ‘আজ নগদ কাল বাকী’, ‘বাকী চাহিয়া লজ্জা দেবেন না’- বিভিন্ন চিত্রপটের উপর এসব লেখা। শামসুর মূলত দৃশ্যপট আঁকতে শেখার চেষ্টা করেছিলেন। তবে কয়েকদিন পরেই নাঈম মিয়া তাকে না করে দেন। সেই প্রত্যাখানকে শামসুর রাহমান বলছেন তার আজকের জীবনে আসার অন্যতম বাঁকবদল।
শামসুর রাহমানের লেখালেখির সূত্রপাত অনেক দেরিতে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার জবানীতেই। তিনি যখন ঢাকা কলেজে পড়তেন তখন তার সহপাঠি ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। একদিন শামসুর কলেজে তার ক্লাসের সামনে বারান্দায় বসে ছিলেন, তখন হুট জিল্লুর রহমান এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি লিখেন?’ প্রশ্ন শুনে শামসুর চমকে গিয়েছিলেন। তিনি তো লিখেন না। তাই তিনি জবাব দিলেন, তিনি লিখেন না। জিল্লুর রহমান এটা শুনে বলেছিলেন, আপনার তো লেখা উচিৎ এবং আপনাকে দেখলেই মনে হয় আপনি লেখালেখি করেন। তারপর থেকে শামসুর রাহমানের সঙ্গে জিল্লুর রহমানের ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কলেজে পড়াকালীন যখনই মন খারাপ হতো চলে যেতেন জিল্লুর রহমানের মেসে। তবে জিল্লুর রহমান তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন কিন্তু শামসুর রাহমান লেখা শুরু করেন আরো পরে।
শৈশব-কৈশোরে পরিবারের চাপে হোক আর নিজের স্বভাবগুণে হোক খুব বেশি দূরন্ত এবং দূর্দান্ত ছিলেন না শামসুর রাহমান। ততে দুষ্টু যে একটু ছিলেন তা তার নিজের জবানীতে পাওয়া যায়। কৈশোরে ১৯৪০ সালে যখন মাহুতটুলি ছেড়ে বছর দুয়েকের জন্য ইস্কাটনে থাকতে এসেছিলেন তখন তার কিশোর মনে জায়গা নিয়েছিল দিলারা। কিন্তু সেটাও পরিণতি পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। কেবল চোখের চাহনি আর ঠোঁটের মিষ্টি হাসিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এর বেশি বাড়ার সাহস হয়নি তার। পরে, পগোজ স্কুলে পড়াকালীন তারই এক ফুপাতো/খালাতো বোন হেনা তার পিছু নিয়েছিল। হেনা তাকে পছন্দ করতো এটি বুঝার মতো বয়স তখন বাচ্চু বা শামসুর রাহমানের ছিল। তবে সেটাও আর হয়ে উঠেনি কোন প্রেম কাহিনী।
তবে সময়ের সাথে শামসুর রাহমান শৈশব-কৈশোরের মতো ভদ্রোচিত মানুষটি থেকে গেলেও তার কলম, চিন্তা হয়ে উঠে শাণিত। তাই তো শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির কয়েক দিন আগে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘আর যেন না দেখি’ শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেন। পরে কবিতাটি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত কবিতা সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-তে স্থান পায়। কবিতাটিকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে স্থান দেওয়ার পেছনে হাসান হাফিজুর রহমানের যুক্তি ছিল, ‘এই কবিতায় পরবর্তী একুশে ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক অথচ বীরোচিত ঘটনার পূর্বাভাস বিদ্যমান’।
আরো পরে, পাকিস্তানের তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে সিকান্দার আবু জাফরের সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকালে’ লিখেন 'হাতির শুঁড়' কবিতা। এবং সেটা দিয়েই এক বন্ধুর পথে যাত্রা সূচনা। সেই সময়েই কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লিখেন 'টেলেমেকাস'। ১৯৬৮ সালে যখন পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেছিলেন আইয়ুব খান তার প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন শামসুর রাহমানই। সৃষ্টি হলো 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'। পুলিশের গুলিতে আসাদের শহীদ হওয়ার পর রচিত 'আসাদের শার্ট'।
এসব লেখার পর শামসুর রাহমানকে চিনে নিতে আর বাকী থাকেনা। কবিতা দিয়ে জাতি এবং ভাষার প্রতি দায় শোধের যে যাত্রা শামসুর রাহমান শুরু করেছিলেন তাতে শামসুর কতো নম্বর পাবেন তা নিয়ে বিকর্ত থাকতে পারে। তবে শামসুর যে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা কবিতায় এক অনন্য জায়গা করে নিয়েছেন তা বোধকরি কেউই অস্বীকার করবে না।
সাম্প্রতিক সময়ের সাম্প্রদায়িক কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়িটা হয়তো শামসুর রাহমান আরো আগেই টের পেয়েছিলেন। কেননা ৪৭ এর দেশ বিভাগ তো তার চোখের সামনে দেখা। যেমন নিজের চোখে দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দূর্ভিক্ষও। তাই শামসুর এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে হোক আর পরবর্তী বোঝাপড়ার আলোকে হোক শামসুর রাহমান এই ক্ষতের কারণ এবং সমাধান দেখতে পেয়েছিলেন অনেক আগেই। তাই বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এই উপমহাদেশের কিছু সংখ্যক গোঁড়া, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদের একগুঁয়েমির দরুণ, ষড়যন্ত্রের ফলে এক নিদারুণ ট্রাজেডির শিকার হতে হয়েছে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে, যার জের যুগ যুগ ধরে চলবে, যদি না বিরাট কোনো পরিবর্তনের সূচনা হয়...।’ হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাতচল্লিশ সালে সংগঠিত দেশভাগ সম্পর্কে আত্মজীবনীতে এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন কবি শামসুর রাহমান। ফলে, চিন্তায়, লেখনীতে শামসুর রাহমান যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও প্রাসঙ্গিক কবি তা বারবার উচ্চারণ না করলেও চলে।
১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর জন্ম নেওয়া এই কবি ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। মারা যাওয়ার আগে দুহাত ভরে কবিতা বিলিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যে। ৬৬ টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' (১৯৬০), 'রৌদ্র করোটিতে' (১৯৬৩), 'বিধ্বস্ত নিলীমা'(১৯৬৭), 'নিরালোকে দিব্যরথ' (১৯৬৮), 'নিজ বাসভূমে' (১৯৭০), 'বন্দী শিবির থেকে' (১৯৭২), 'ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা' (১৯৭৪), 'বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে' (১৯৭৭), 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে' (১৯৮৩), 'দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে' (১৯৮৬) এবং 'হরিণের হাড়' (১৯৯৩) ইত্যাদি। এছাড়াও লিখেছেন ৪ টি উপন্যাস। প্রবন্ধ গ্রন্থ ২ টি। ৩টি বিদেশী কাব্যগ্রন্থ অনুবাদও করেছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শামসুর রাহমান গদ্য লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার লিখিত গ্রন্থের পরিমাণ ও ধরণ এই দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে শামসুর রাহমান গদ্যেও ঝরঝরে। সুখপাঠ্য। তার আত্মজীবনী পাঠ করলে সেটা ধরতে পারা যায়।
শামসুর রাহমান বাংলা কবিতা এবং বাংলা ভাষার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। অমর না হতে চেয়েও অমর হয়ে আছেন তিনি। যেমনটা তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পরেও যদি’ কবিতায়:
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
সেই সুনীল পাখিটির খবর কি কেউ জানেন? নাকি বাংলাসাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া সুনীল পাখি আমাদের শামসুর রাহমান?