যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ আমাদের মাঝে আসেন যারা সারাটা জীবন ধরে শুধু পরোপকারে কাজ করে যান। ক্ষণজন্মা এই মানুষগুলো একদিকে যেমন সমাজের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ, পাশাপাশি তারা নতুন যুগের পথপ্রদর্শক। তেমন একজন মানুষ ডা. ইউনুস আলী খান। ১৯৪৪ সালের ৩ মার্চ পাবনা সদরের চরতারাপুর ইউনিয়নের স্বনামধন্য এক পরিবারে জন্ম নেন তিনি। ডা. ইউনুস সুজানগর থানার দুবিলিয়ায় প্রাথমিক স্কুল শেষে পাবনার গোপালকৃষ্ণ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডেয়ট ও বিএসসি পাশ করেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল থেকে ১৯৬৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাশ করেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং রাজশাহী মেডিকেলে পড়াকালীন সময়ে তৎকালীন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
ছাত্রজীবন শেষে জন্মস্থান পাবনায় প্রাকটিস শুরুর কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে সীমান্তে পৌঁছান। সীমান্ত অঞ্চলে তাঁর ডাক্তার পরিচয় পেয়ে তাঁকে ঐ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব দিয়ে দেশের ভেতরেই অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশের ভেতরে বিশেষত পাবনা ও পদ্মার চরাঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসা সেবা প্রদান ও আশ্রয় দান করেন। পাবনার গ্রামাঞ্চলে তার চিকিৎসায় প্রাণরক্ষা হয়েছে এমন মুক্তিযোদ্ধা এখনও সেই সাক্ষ্য বহন করছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে ‘তরুণ চিকিৎসকদের গ্রামে যাওয়ার’ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭২ সালে নিজ পরিবার ও মৃত বড় ভাইয়ের ৭ সন্তানের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার নিয়ে শাহজাদপুরের পোতাজিয়া সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন তিনি। এরপর শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। ধীরে ধীরে চিকিৎসক হিসেবে তার কর্মপরিধি বিস্তৃত হতে শুরু করে। কর্মঠ এই মানুষটি চিকিৎসা পেশাকে শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে কখনও গণ্য করেননি।
তিনি শাহজাদপুরের প্রথম এমবিবিএস চিকিৎসক। চাকরিজীবনে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত হওয়ার কারণে ‘৭৫-পরবর্তী সময়ে নানাবিধ হয়রানির শিকার হন। কিন্তু তিনি সততা ও আদর্শের সঙ্গে কোনও প্রকার আপোষ না করে জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে তাকে অন্যত্র বদলি করা হলে তিনি রোগীদের ও শাহজাদপুরবাসীর ভালোবাসার টানে প্রিয় শাহজাদপুর না ছেড়ে চাকরি ছেড়ে দেন ও শাহজাদপুরেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার এই সিদ্ধান্তে উপকৃত হয়েছে অসংখ্য মানুষ, তিনি হয়ে উঠেছেন শাহজাদপুরের সকল মানুষের ভরসার পাত্র। ডা. মো. ইউনুস আলী খান ছিলেন সৎ, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী একজন চিকিৎসক। ডা. ইউনুস গত ৫০ বছর ধরে সপ্তাহের প্রতিদিন নিরলস চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। চিকিৎসা সেবায় গোটা শাহজাদপুর উপজেলার জন্য তিনি ছিলেন সম্মানীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পাবনা-সিরাজগঞ্জ জুড়ে তার খ্যাতি ছিল। তার চিকিৎসা সেবা ছিল কিংবদন্তীতুল্য। তিনি রোগীদের মনে এমন একটা আস্থার জায়গায় পৌঁছেছিলেন যে তার রোগীরা বলতো যে তার চেহারা দেখেই অর্ধেক সুস্থ হয়ে যান। ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও দরিদ্রদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিতেন তিনি। প্রয়োজনে চিকিৎসার পাশাপাশি নিজের টাকায় রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতেন। তিনি বলতেন- ‘পয়সার জন্য চিকিৎসা আটকে থাকবে না’।
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু অনুরক্ত এই চিকিৎসক আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে গেছেন। প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন ডা. ইউনুস আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে শাহজাদপুরে বঙ্গবন্ধু পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আমৃত্যু এই সংগঠনের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শুধু চিকিৎসক হিসাবেই নয় একজন সমাজসেবক হিসাবে শাহজাদপুরের যেকোনও সাংস্কৃতিক সামাজিক কর্মকাণ্ডে সবসময়ই ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। দারিয়াপুরে তার চেম্বারটি শাহজাদপুরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের এক মিলনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন সবার ভরসার প্রতীক। তার চেম্বারই ছিল এই এলাকায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুতিকাগার। সবার আহ্বানে তিনি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রস্তাবনা পাশ থেকে শুরু করে জনসচেতনতা তৈরি এমনকি দাবি আদায়ে রাজপথের আন্দোলনেও অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী ভিসা (গ্রিন কার্ড) থাকা সত্ত্বেও দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার টানে তিনি কখনওই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি শুধু একজন স্বনামধন্য চিকিৎসকই নন, শাহজাদপুরের গণমানুষের ভাষায় তিনি ছিলেন- ‘সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরের একটি বাতিঘর’।
ভ্রমণ ও আলাপপ্রিয়, বন্ধুবৎসল, অসম্ভব পড়ুয়া এই মানুষটি লেখালেখিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবিতা লিখতে ভীষণ ভালোবাসতেন। করোনা সংকটের সময়ে ৭৮ বছর বয়সের ডা. ইফনুস আলী খান তার প্রবাসী সন্তানদের অনুরোধ উপেক্ষা করে রোগী দেখা চালিয়ে যান এবং দুঃখজনকভাবে এক পর্যায়ে তিনি করোনা আক্রান্ত হন। ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে ২৪ জুন সকাল ১১টায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
জনসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ তাকে ‘অমর একুশে’ সম্মাননা পদক দেয়।সম্প্রতি তার চেম্বারের সামনের সড়কটি শাহজাদপুরের জনসাধারণ তার স্মৃতির স্মরণে ‘ডা. ইফনুস আলী খান সড়ক’ নামকরণ করেছে। ডা. ইউনুস আলী খানের মৃত্যু শাহজাদপুরের মানুষের জন্য শোকের চেয়েও বেশি কিছু। তার অবর্তমানে এই অঞ্চলের গণমানুষের সেবায় স্থায়ী কিছু করে যাওয়ার অভিপ্রায় তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। আর তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও কর্মের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ডা. ইফনুস আলী খান ফাউন্ডেশন’। তার কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি এই অঞ্চল তথা শাহজাদপুরের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়