ওস্তাদ রশিদ খান

সুরের বাগানে এমন ফুল সচরাচর ফোটে না

মাহাবুব আলম শ্রাবণ

জানুয়ারি ৯, ২০২৪, ০৯:৪৬ পিএম

সুরের বাগানে এমন ফুল সচরাচর ফোটে না

ওস্তাদ রশিদ খান

চলে গেলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম নক্ষত্র সুরের জাদুকর ওস্তাদ রশিদ খান। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৫৫ বছর বয়সেই পাড়ি জমালেন পরপারে। তিনি দীর্ঘদিন কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ৩টা ৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে  বিনোদন অঙ্গনে। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সাথে ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম ও পুলিশ কমিশনার বিনীত গয়াল।

এ সময় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম রশিদ খান সুস্থ হয়ে উঠুক। আমার সঙ্গে নিয়মিত তার যোগাযোগ ছিল। আমাকে বলত, আমি ওর মায়ের মতো।  রশিদ আলি খান বিশ্ববিখ্যাত নাম। নতুন করে তাঁর পরিচয় দিতে হবে না। শিল্পী হিসেবে তিনি সংগীত সম্রাট। উত্তরপ্রদেশ তাঁর জন্ম হলেও, বাংলাকে ভালোবেসে বাংলায় থেকে গিয়েছেন। রশিদ আমার ভাইয়ের মতো। ওর চলে যাওয়াটা এক অপূরণীয় ক্ষতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গোটা বিশ্বে তিনি সংগীত প্রচার করেছেন। তিনি নিজে বঙ্গভূষণ, পদ্মবিভূষণও পেয়েছেন। রশিদ খানের ছেলেও খুব ভালো গান গায়। ছেলেকে খুব ভালো করে তৈরিও করেছেন। মেয়েরাও খুব ভালো। খুব অল্প বয়সে চলে গেল। এটা আমাদের কাছে খুব দুঃখের।’

ওস্তাদ রশিদ খান ছিলেন রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ইনায়েত হোসেন খানের প্রপৌত্র। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে হালকা বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তিনি।

পিয়ারলেস হাসপাতালের চিকিৎসক সুদীপ্ত মিত্র জানিয়েছিলেন, ‘শিল্পীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন, তার মধ্যেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে ছিলেন, সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। বছরের শেষে তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছিল। চিকিৎসায় সাড়াও মিলেছিল।’

পরবর্তীকালে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় শহরের বাইরে থেকে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনও করা হয়েছিল তাঁর। এরপর শুরু হয় একাধিক সমস্যা। মাঝেমধ্যেই নেমে যেত প্লাটিলেট । তখনই ভর্তি হতে হত হাসপাতালে। ২১ নভেম্বর স্ট্রোক হওয়ার পর থেকেই আইসিইউ-তে ছিলেন শিল্পী। মঙ্গলবার ভোরে অবস্থা এতটাই অবনতি ঘটে, যে তাঁকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।

চিকিৎসকদের চেষ্টা সত্ত্বেও শেষরক্ষা হল না আর।

তাঁর কণ্ঠের একের পর এক গান মন কেড়েছিল ভক্তদের। হিন্দি বাংলা সমস্ত ভাষায় তাঁর কণ্ঠে মেতেছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি টালিউড ও বলিউডেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। 

বহু পুরস্কার রয়েছে ওস্তাদ রাশিদ আলি খানের ঝুলিতে। ২০০৬ সালে তিনি পদ্মশ্রী ও পাশাপাশি সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালে বঙ্গভূষণ পুরস্কার, ২০১০ সালে গ্লোবাল ইন্ডিয়ান মিউজিক অ্যাকাডেমি পুরস্কার , ২০১২ সালে মহা সঙ্গীত সম্মান পুরস্কার, ২০১৩ সালে মির্চি মিউজিক পুরস্কার , এবং ২০২২ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার পান।

দীর্ঘ একমাস লড়াইয়ের পর সেতারের সুরের কণ্ঠ থেমে গেল চিরদিনের মতো। শিল্পীর অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক শোনা থেকেই চারিদিকে প্রার্থনা শুরু  হয়েছিল। সকলের মনে আশা ছিল, ঠিক ভালো হয়ে ফিরে আসবেন প্রিয় শিল্পী। কিন্তু আর ফেরা হল না।

কলকাতার লেখক ও শিক্ষক লিপিকা ঘোষ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ওস্তাদ রশিদ খান মৃত্যুবরণ করেছেন বছরের শুরুতেই। সবচেয়ে দুঃখজনক সংবাদ। ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি গুরুতর অবস্থায় কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তখন থেকেই আশঙ্কা ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমরা অনেকেই তাঁকে গভীরভাবে অনুসরণ করতাম। আমাদের কালের, এমনকি বলা যায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হাজার বছরের ইতিহাসেই এমন কণ্ঠ দুর্লভ।

কণ্ঠশিল্পী অসীম রায় দ্য রিপোর্ট ডট লাইভে জানান, তাঁর গাওয়া গানগুলো এখনো গাই, তিনি অনুসরণীয় অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সংগীত জগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বেঁচে থাকবেন হাজারো ভক্তের হৃদয়ে। 

কলকাতার সংবাদকর্মী তিথী দাস দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, রশীদ খান সাহেবের পরম্পরাও ছিল সমৃদ্ধ - নানা ওস্তাদ নিসার হোসেন খান ও মামা ওস্তাদ গোলাম মোস্তফা খান। হয়ত এমন একটি কণ্ঠের জন্য আমাদের, এমনকি প্রজন্মকেও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। সুরের বাগানে এমন ফুল সচরাচর ফোটে না। তাঁর মৃত্যুতে শ্রদ্ধা ও গভীর শোক জানাই।

মুখ্যমন্ত্রীর বরাতে জানা যায়, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত  হাসপাতালেই থাকবে এই কিংবদন্তি শিল্পীর মৃতদেহ। আগামীকাল বুধবার (১০ জানুয়ারি) দুপুর ১টায় রবীন্দ্রসদনে গানস্যালুট দেওয়া হবে। এবং টালিগঞ্জের কবরস্থানে তাঁর দাফনকাজ সম্পন্ন হবে।

তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া সংস্কৃতি জগতে। শাস্ত্রীয় সংগীত বা ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের একজন দিকপাল তিনি। রশীদ খানের প্রতিটা গান যেন মায়ার বাঁধনে ভরপুর। তাঁর প্রতিটা সৃষ্টি আজও মানুষের মনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়।

Link copied!