`প্রিয়র কাজ, আগে খুব বেশি দেখিনি। কিন্তু ও যখন নেই, তখন ওর কাজ দেখে মনে হয়, নিজের গণ্ডিতে সাফল্য এনেছে। আর আপনাদের কথা শুনে মনে হলো, আসলেই প্রিয় সকলের কাছে প্রিয় ছিল।`
শনিবার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের অফিসে সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র স্মৃতিচারণে এমনটাই বলেন তার মা শামসী আরা জামান। ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত হন প্রিয়।
সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা বলেন, ‘ও জীবনটা গুছিয়ে এনেছিল। মেয়েকে স্কুলে দিয়েছিল। ঢাকায় নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। একটা স্বপ্ন ছিল। এখন ওর ছোট্ট সন্তানটাকে বড় করাই আমার স্বপ্ন। ওর মতো ছেলেদের জন্য আমি সুস্থ-সুন্দর একটা সমাজ চাই।’
তাহির জামান প্রিয়র কথা বলতে গিয়ে মা বলেন, ‘তার ছেলে প্রচুর বই পড়তো। দেশজগতের খবর রাখতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। স্বপ্ন ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের।’
শামসী আরা জামান জানান, তিনি ঢাকায় আসার আগের দিন তাহির জামান প্রিয়র মেয়ে পদ্মপ্রিয় পারমিতা অনেক কান্না করেছে। কাঁদতে কাঁদতে সে বলছিল, ‘আমি আমার প্রিয় বাবার কাছে যাবো। প্রিয় বাবাকে নিয়ে আসবো। প্রিয় বাবা আমাকে আর ঘাড়ে নেয় না।’
শামসী আরা জামান বলেন, ‘মেয়েটি সবাইকে বলে তার প্রিয় বাবা মারা গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সে নিজেই বুঝতে চায় না যে বাবা আর নেই। এসময় ছেলে ও নাতির কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডে সংঘর্ষ চলাকালীন নিহত হন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাবেক ভিডিও জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়।
কোটা আন্দোলন ছাড়াও সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলন ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া তাহির জামান প্রিয়।
তারই অকালপ্রয়াণে স্মরণ করার জন্য এসেছিল তাহির জামান প্রিয়র সাবেক সহকর্মী। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের অফিসে দুপুর থেকেই আসতে শুরু করে সহকর্মীরা।
চিত্রগ্রাহক ও কিউরেটর আমিরুল রাজিব বলেন, প্রিয় অনেকটা অগোছালো ছিল। এই অগোছালো ব্যক্তিটাই দেশটাকে হয়ত গোছালো করতে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করে গিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রিয়র এত বেশি দক্ষতা ছিল যে ও এত ভাল ছবি আঁকত হয়ত এটা আপনারা কেউ জানেন না। প্রথাগত কোনো শিক্ষা না পেলেও নিজের দক্ষতায় এই ছবি আঁকা শেখে। আর ওর কাজের এত গভীরতা সেটা দেখে আমরাই অবাক হয়ে গিয়েছি। যখন জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে শিখলে প্রিয় তখন বলল ভাই হয়ে গেছে এমনি।
বাংলাদেশে ইন্টার্ন করতে এসে প্রিয়র কাজ দেখে তাৎক্ষণিক ৪-৫ টা ছবি ক্রয় করে অনেকে। আমি তখন বলি, চারুকলার লোকজনই ছবি বেচতে পারে না তুমি প্রিয় ছবি বিক্রিও করে দিলে। ঠিক এতটাই প্রতিভাবান ছিল প্রিয়।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২৮ অক্টোবর বিএনপির তাণ্ডবে আহতও হয়েছিলেন তিনি। চলতি বছর ১০ জানুয়ারি মেয়ে পদ্মপ্রিয় পারমিতার সঙ্গে আগেই শেয়ার করে রাখা একটি ছবিকে প্রোফাইল পিকচার বানিয়ে আবেগঘন ক্যাপশন লেখেন প্রিয়।
শেয়ার করা সেই পোস্টের ক্যাপশনে তিনি লিখেছিলেন, “আমার মেয়ে পদ্মপ্রিয় পারমিতা। ৪ বছরে পা দিয়েছে পাখিটা। কাল থেকে ওর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। প্রথম স্কুল পদ্মর। ওর বাবা ও মা একই সাথে আমিই। সিংগেল ফাদার, আবার মায়ের দায়িত্বও আছে। আমার অতীত যা ছিল সেটা সুখকর নয়। কিন্তু অনাগত ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অনেক অনেক সুখকর হবে ইনশাআল্লাহ। সবাই দোয়া করবেন আমার মেয়েটার জন্য।”
চিত্রকর্ম, ফটোগ্রাফিসহ সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে পছন্দ করতেন প্রিয়। বিভিন্ন সিনেমা ও সিরিজ নিয়ে পর্যালোচনা (রিভিউ) করার বিষয়ে তার ছিল বিশেষ দক্ষতা ও আগ্রহ। পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি (পেশাদার আলোকচিত্র) কোর্সের ওপর ডিপ্লোমা অধ্যয়ন করেন তিনি।
মাত্র ৫ মাস আগে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ ছেড়েছেন তাহির জামান প্রিয়। দুই দফায় এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ২০২৪’র ফেব্রুয়ারিতে মাল্টিমিডিয়া অনলাইন নিউজ পোর্টালটির ভিডিও জার্নালিস্ট পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন প্রিয়। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভে যোগ দিয়েছিলেন প্রতিভাবান এই তরুণ।
প্রিয়’র সাবেক সহকর্মী সময় টেলিভিশনের আল আমিন তুষার বলেন, আমার মনে হয় প্রিয় ভাই যে মানের কাজ করে তাতে বাংলাদেশের কোন মিডিয়া হাউস প্রিয় ভাইয়ের মত প্রতিভাবানকে কাজে লাগাতে পারবে না। দীর্ঘ সময় এক সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গেলে তাহির জামান প্রিয় অসম্ভব মেধাবী এবং বিচক্ষণ মানুষ।
দুর্দান্ত ক্যামেরা চালাতে পারতো, ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসত ছেলেটা। আড্ডাবাজ মানুষ ছিল প্রিয়, আর সবচেয়ে বড় যে বিষয় সে একটা স্বপ্নবাজ মানুষ। নিজ দেশ নিয়ে সিনেমা বানানোর খুব ইচ্ছে ছিলো ওর।
কোনোদিন কখনো এমন শুনিনি কারোও সাথে ওর ঝগড়াবিবাদ হয়েছে। সদাহাস্যজ্বল ওর নাম যেমন প্রিয় ও সবার কাছে সে তেমনই প্রিয় ছিলো। ওকে সবাই খুব স্নেহ করতো, ভালোবাসতো কাউকে অল্পতেই ভালোবেসে কাছে টানার অসম্ভব ক্ষমতা ছিলো প্রিয়’র, জানিয়েছেন আরেক সহকর্মী ফারুক হোসেইন।