শেখ কামালের সঙ্গে আমার দেখা একবারই হয়েছে। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ। সেই একাত্তরে কলকাতায় অবস্থান করেন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের সকল উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দলের নেতারা। তারা প্রবাসী সরকার পরিচালনা করছেন। মুক্তিযুদ্ধও পরিচালিত হচ্ছে তাদের মাধ্যমেই।
আমার ঘনিষ্ঠজন ছিলেন শেখ কামালের পিসতুতো ভাই শেখ ফজলুল হক মণি, তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা এবং লেখক। কলকাতায় আসলেই আমার সঙ্গে দেখা করতেন। শেখ কামালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতার জন্য কলকাতার শিল্পীদের পক্ষ থেকে অর্থ সহযোগিতা প্রদান করার সময়। উনি সম্ভবত তখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রধান সেনাপতির অধীনস্থ কোন দায়িত্ব পালন করছেন, এত বছর পরে ঠিক মনে করতে পারছি না।
দশ থেকে পনেরো মিনিটের মতো কথা হয়েছিল শেখ কামালের সঙ্গে তখন, সেই মুগ্ধতা এখনও আমি অনুভব করি। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে রুদ্র সাইফুল ফোন করে জানালো শেখ কামালকে নিয়ে লিখতে হবে, অনুরোধ রাখতে গিয়ে কিছু লিখছি। স্মৃতি অনেক সময় ঝাপসা হয়ে যায়, তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সামান্য স্মৃতিটুকু তুলে ধরছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলাম নিজ নিজ অবস্থান থেকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার শরণার্থীদের বিশাল চাপ সামলাচ্ছে পরম মমতায়। আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী সর্বাত্মক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
বাংলা ভাষার একটা নিজস্ব দেশ হবে এটা অনেক বড় পাওয়া। সেই যুদ্ধকালীন সময়েই আমার পরিচয় ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে। তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। ভারতবাসী আমাদের কাছে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মতোই আরাধ্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে পরম মমতায় বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করে-তিনি আজ বাংলাদেশের জাতির পিতা।
শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন ঋষিতুল্য মহান নেতার ছেলের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি আনন্দিত, সম্ভবত আমি নিজেই আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছিলাম, কীভাবে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চরম মূল্য দিচ্ছে তা আমাদের সাবলীল ভঙ্গিতে বুঝিয়ে বলেছেন তিনি।
বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, শিল্পকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, ক্রীড়াঙ্গনের স্বাধীনতা বাঙালির জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়েই কথা হচ্ছিল। আমি মুগ্ধতা নিয়ে শুনছিলাম স্বল্পভাষী শেখ কামালের কথা।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংস্কৃত অঙ্গনের বন্ধুদের কাছে শুনেছি তার সাংগঠনিক দৃঢ়তার কথা। আমার বন্ধুরা জানিয়েছেন, একাই শেখ কামাল গড়ে তুলেছেন একের পর এক নাট্য সংগঠন, গানের সংগঠন, উপমহাদেশের সেরা ক্রীড়া ক্লাব। তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় হতো-এটা হলফ করে বলতে পারি।
এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা স্বল্পভাষী রাজনীতিবিদ আমি কম দেখেছি। শেখ কামালের সঙ্গে সামান্য সেই আলাপচারিতা আজও আমাকে স্মৃতিকাতর করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের সবার সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়। এতটা বিনয়ী, স্বল্পভাষী সংস্কৃতমনা একজন অতি সাধারণভাবে জীবন বেছে নেওয়া অসাধারণ মানুষকে কেউ হত্যা করতে পারে! আজ তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ লিখতে গিয়ে আমি নিজে সম্মানিত বোধ করছি।
লেখক: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা, কবি এবং আবৃত্তিকার; তাঁকে বাঙলা চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক ধারকমুদ্রা বলা হয়।
(রুদ্র সাইফুল সম্পাদিত ‘শেখ কামাল : মুক্তপ্রাণের প্রতিনিধি’ গ্রন্থে প্রকাশিত; রচনাকাল: ৬ জুলাই ২০১৬)